ময়ূরের পেখম কেন চোখের মতো দেখায়? এ নিয়ে উত্তর রামায়ণে একটি গল্প আছে। ইন্দ্র একবার রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে পারছিলেন না। এক প্রকার পরাস্ত হয়ে ইন্দ্রদেব যার ডানার নিচে লুকিয়েছিলেন, তিনি হলেন এই ময়ূর। পরে দেবতা ইন্দ্র খুশি হয়ে ময়ূরকে হাজার চোখ দান করেছিলেন। সেই চোখগুলোই ময়ূরের পেখমে দেখা যায়। আরও একটি বর তিনি দিয়েছিলেন, সেটি হলো সাপকে পরাস্ত করার শক্তি। হিন্দুদের কাছে তাই এ ময়ূর অনেক বেশি পবিত্র। পবিত্র আরও একটি কারণে, সেটি হলো, এ দেবতা ইন্দ্রেরই বাহন হলেন ময়ূর। এ ছাড়া হিন্দুদের আরাধ্য দেবতা ভগবান কৃষ্ণের মাথায় যে পালকটি দিয়ে শোভিত করা হয়, সেটি আসলে ময়ূরের পাখা।
ময়ূর দেখতে খুবই চমৎকার। এর রং অনেক আকর্ষণীয়। বিশেষ করে এর পালক অনেক উজ্জ্বল আর সবুজ-নীল রঙের। পালকে চোখের মতো ফোঁটা ফোঁটা দাগ থাকে। ময়ূর সাধারণত ৮৬ সেমি লম্বা হয়। কিন্তু পালকসহ হিসাব করলে এর দৈর্ঘ্য হয় ২ থেকে ২.৫ মিটার। ময়ূর আর ময়ূরী চিনবেন কীভাবে? ময়ূরীর পেখম মেলার মতো লেজে উজ্জ্বল লম্বা পালক থাকে না। ঘাড়ের নিচের দিকটা উজ্জ্বল সবুজ রঙের হয়। এর পেট সাদা রঙের আবার এর সঙ্গে কিছুটা হলুদ রঙের আভাও থাকে। পালকগুলো পাখার মতো থাকে। পুরুষ ময়ূরের ঠোঁট থেকে লেজের দৈর্ঘ্য হয় ১০০ থেকে ১২০ সেমি। এর ওজন ৪.১ থেকে ৫.২ কেজি। স্ত্রী ময়ূরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৮ সেমি থাকে। ওজন হয় ২.৭ থেকে ৪.১ কেজি। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় ময়ূরেরই চোখ হয় বাদামি রঙের, ঠোঁট আর পা-ও বাদামি রঙের হয়ে থাকে।
এরা সাধারণত বন, ছোট ছোট পাহাড়, জলের কাছাকাছি কোনো জায়গায় থাকে। ঝোপঝাড় আর আবাদি জমির পাশেও এদের দেখা যায়। মানুষের ঘরের কাছাকাছি অনেকটা গৃহপালিত পাখির মতোও এরা থাকতে পারে। এ ময়ূরগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে। মাটিতে খাবার খুঁজে বেড়ায় এরা। এরা সর্বভুক। ঘাস, শস্য বীজ, ফুলের কুঁড়ি, ফল, পোকামাকড়, ছোট ছোট সরীসৃপ এদের খাবার। এরা সাপ খায়। ছোট ছোট সাপ খেতে দেখা যায়। চাষের জমিতেও এরা খাবার খায়। কাছাকাছি জলাশয় থাকলে হেঁটে হেঁটে সেই জলাশয়ের কাছে যায় দল বেঁধে। চাষের জমিতে চীনাবাদাম, টমেটো, ধান, মরিচ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এক-একটি দলে একটি ময়ূর ও অন্যান্য তিন থেকে পাঁচটি ময়ূর থাকে। আবার অনেক সময় বিশেষ করে প্রজনন সময়ের পর এক-একটি দলে স্ত্রী ও শাবকরা থাকে। ময়ূররা একেক সময় একেকভাবে থাকে। যেমন ভোরবেলায় এদের খোলা জায়গায় দেখা যায়। আস্তে আস্তে দিনের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা আড়ালে চলে যায়। সন্ধ্যার দিকে এরা প্রায়ই ধুলোবালিতে থাকে। এদের বাসা সাধারণত লম্বা লম্বা গাছে দেখা যায়। তবে পাথরের গর্তেও দেখা গেছে। আবার বিভিন্ন ভবনেও এদের বাসা বানাতে দেখা গেছে। অন্যান্য পাখির মতো ময়ূররাও সন্ধ্যায় তাদের বাসার কাছে আসে। ঘন ঘন ডাকতে থাকে। এরা উড়তেও পারে। প্রধানত হাঁটে। ভয় পেলে গাছ বেয়ে ওপরে উঠে পড়ে।
বাংলাদেশে নীল ময়ূর দেখা আগে মিললেও বর্তমানে প্রজাতিটি বিলুপ্ত। একসময় শালবনে এটি থাকলেও এখন আর দেখা যায় না। একটি তথ্যমতে, সর্বশেষ ১৯৮২ সালের দিকে মধুপুর জাতীয় উদ্যানে নীল ময়ূর দেখা গেছে। বন বিভাগ সম্প্রতি এ প্রজাতিটি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনের গভীরে সবুজ ময়ূর পাওয়া গেলেও এ প্রজাতিটিও হারিয়ে যাওয়ার পথে। এসবের বিলুপ্তি হওয়ার বড় কারণ আবাসস্থল ধ্বংস। বন থেকে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া আগ্রাসী উদ্ভিদও একটি কারণ। তা ছাড়া রয়েছে পাখি পাচারের ঘটনা। কীটনাশক আর আগাছানাশক ব্যবহারের কারণে পোকামাকড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে ময়ূরের ওপর। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিষয়গুলো তো আছেই। তবে আশার কথা হলো, গত ২৬ মে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর শালবনে দোখলা রেঞ্জের লহরিয়া বিটে পাঁচ জোড়া ময়ূর অবমুক্ত করা হয়েছে। যদিও অনেকে এগুলো থাকতে পারবে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ করছেন। কেননা বনের পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, অভিযোজন এ বিষয়গুলোও ভাবার রয়েছে। তবে আমরা আশাবাদী হতে চাই। এ নিয়ে প্রয়োজনে আরও গবেষণা করার প্রয়োজন পড়লে করা হোক। কী করলে নীল ময়ূরগুলোকে তাদের আবাসভূমিতে ফিরিয়ে আনা যাবে, তা নিয়ে কেউ কেউ ভাবছে এটাই আশার কথা। তবে শুধু আশা করলে হবে না বা পাখি অবমুক্ত করলেই হবে না; পাখিকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে চাইলে আগে ঘরকে তো ঠিক করতে হবে। সেই ঘরও ঠিক হোক। তবেই না দেখা মিলবে নীল ময়ূরের যৌবন।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক
মন্তব্য করুন