অবকাঠামোর প্রেক্ষাপটে দেশ অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছেছে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। তেমনই অস্বীকার করা যাবে না, নানান অনাচারের মধ্যে আছে আমজনতা। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে অপ্রতিরোধ্য মশার উপদ্রবে ডেঙ্গু মহামারি পরিস্থিতি, মাদকের লাগামহীন আগ্রাসনে ধ্বংসের দোরগোড়ায় যুবসমাজ এবং প্রায় বোরাকে ছুটে চলা দ্রব্যমূল্য। সুশাসনের দৈন্য দশার প্রসঙ্গ নাই বা তোলা হলো। এসবের সঙ্গে প্রায়ই চলমান ঘটনা হচ্ছে, দেশব্যাপী সাংবাদিক পেটানো। নেতা-পাতা-আমলা-কামলা, কারণে-অকারণে প্রায়ই সাংবাদিক পিটিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অনেকটা নবযুগের সূচনা হয়েছে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ২৬ আগস্ট। দুই সহযোগী অধ্যাপকের নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণে একদল সাংবাদিককে আচ্ছামতো প্যাঁদানো হয়েছে। এই আক্রমণের সময় হিন্দু-মুসলিম মহাঐক্য দেখা গেছে। এবং এর সমস্যার ‘মিটমাট’ হয়ে গেছে ঘটনাস্থলেই। এ ন্যক্কারজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর এটি বরিশালের সাংবাদিক সমাজ মেনে নিয়েছেন। এর আগে ঘটনাস্থলে বরিশালে সাংবাদিক নেতা হিসেবে পরিচিত দুজন টেলিভিশনে সাবধানী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আর সাংবাদিকদের ওপর হামলার পাঁচ দিনের মাথায় ৩০ আগস্ট বিচার চেয়ে ছোটখাটো মানববন্ধন করেছে বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন। এতে অন্যান্য সাংবাদিক সংগঠনের পরিচিত মুখগুলো দেখা গেছে। এ মানববন্ধন থেকে ১০ দিনের কাগুজে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। বোঝা গেছে, সাংবাদিক পেটালে কার্যকর প্রতিবাদ করার মতো যেন কেউ নেই। এই হচ্ছে অবস্থা! অথবা সাংবাদিক পেটানো এতটাই স্বাভাবিক ঘটনা যে, এ নিয়ে তেমন বলার কিছু নেই। অবশ্য যা ঘটে তাই স্বাভাবিক ধরে নিলে মনঃকষ্ট কম হয় এবং এ ধারা চলমান।
মনঃকষ্ট প্রসঙ্গে প্রথমেই দ্রব্যমূল্যের বিষয়ে আসা যাক। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আলু-পটোল-আন্ডা-মাছ-মাংস-তরিতরকারি-কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ-রসুন-আদা-গরম মসলা-ঠান্ডা মসলা, সবকিছুর দাম চড়া এবং মাঝেমধ্যে বোরাকের পিঠে দুরন্ত বানরের মতো লাফালাফি করে। আর জানা কথা, এ হচ্ছে সিন্ডিকেটের কারসাজি। অবশ্য এ প্রসঙ্গে ২৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাণিজ্যমন্ত্রীকে আমি ধরতেছি।’ নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য জনমনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে। অবশ্য পরদিনই ৩০ আগস্ট এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রায় দেড় ঘণ্টা তার সঙ্গে ছিলাম। তখন তিনি এ বিষয়ে কিছু বলেননি।’ সব মিলিয়ে দুটি প্রশ্ন উঠতেই পারে। এক, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জনমনের আশার প্রদীপ অকালে নিভে যাবে না তো? দুই, লাগাতারভাবে চলে আসা অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্যের বিষয় যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই দেখতে হয়, তাহলে বাণিজ্যমন্ত্রীর আসনে যিনি আসীন তিনি কি উজিরে খামাখা? যাক এটি অন্য প্রসঙ্গ। এখন দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে ফলাফল দেখার অপেক্ষায় থাকাই বেহেতের। অথবা ধরে নেওয়া যাক, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। একই ভাবে ধরে নেওয়া যাক, সাংবাদিক প্যাঁদানো অথবা পেটানোর ঘটনাও স্বাভাবিক বিষয়। এতে কিঞ্চিৎ মনঃকষ্ট হলেও হতে পারে। ধরা যাক, মনঃকষ্ট হবেই; কিন্তু তাই বলে তো যন্ত্রণা ও নিষ্ঠুরতার বিশাল উপকারের প্রসঙ্গ ভুলে গেলে চলবে না! মনে রাখা প্রয়োজন, যন্ত্রণা এবং নিষ্ঠুরতারও কিন্তু নানান ফজিলত আছে।
সম্প্রতি যন্ত্রণা প্রসঙ্গে আসার আগে ইতিহাসের পাতায় একটু নজর দেওয়া যাক। এর একটি সুদূর এবং অন্যটি কাছাকাছি। একটি দেশে, অন্যটি সীমানা পেরিয়ে বহু দূরে। সুদূরের ঘটনা হচ্ছে, অটোমান সাম্রাজ্যে নতুন সুলতান সিংহাসনে বসেই যুবরাজদের হত্যা করতেন। আর সিংহাসনে বসার পর ভাইদের হত্যা করা ছিল আইনসিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে ইতিহাসখ্যাত নির্মমতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সুলতান মেহমেত তৃতীয়। অটোমান সাম্রাজ্য ক্ষমতার চরম শিখরে অবস্থানকালে ১৫৯৫ সালে মেহমেত তৃতীয় সিংহাসনে বসার দিনটি ইতিহাসে বিশেষভাবে চিহ্নিত। তবে ইতিহাসে সেই দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকার কারণ নতুন সুলতানের আগমন নয়, দিনটি খ্যাত ইস্তাম্বুলের প্রাসাদে ১৯ জন রাজকুমারকে হত্যার ঘটনায়। আবার এটি মনে করার কোনো কারণ নেই, ভাইদের হত্যা করেছেন একমাত্র সুলতান মেহমেত। অটোমান সাম্রাজ্যে যে আইন বা ঐতিহ্যের অধীনে রাজপুত্র এবং রাজকুমারীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো, তা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫ শতকে। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত ১৪৮১ সালে তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে একটি নির্দেশ জারি করেছিলেন। এটি কেবল অটোমান সাম্রাজ্যের জন্য নয়, এটি বিশ্বের জন্য ভালো—এমনটাই বলা হয়েছিল আইনে। সুলতানদের আদেশে ভাই বোনদের হত্যা করার আইনটি ছিল খুবই কঠিন। ফলে অতি দয়ালু হিসেবে পরিচিত সুলতান মুরাদকেও ৯ জন রাজকুমারকে শ্বাসরোধে হত্যার নির্দেশ দিতে হয়েছে। এ ঘটনায় সুলতান মুরাদের হৃদয় ভেঙে পড়েছিল। এর পরও তাকে হত্যা করার আইন মানতে হয়েছে। উল্লেখ্য, অটোমান সাম্রাজ্যের শত শত বছরের রাজত্বে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশ শাসন করেছে, যা অনেকটাই দাঁড়িয়ে ছিল রক্তপাত আর হত্যার ওপর।
আমাদের রাষ্ট্রেও কিন্তু হত্যার বিধান আছে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় আদম সন্তানের প্রাণ সংহারের বিষয়টি সবারই জানা। তবে এটি করা হয় সাধারণের দৃষ্টিসীমার বাইরে, নানান আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সংস্থার বয়ানীতে ক্রসফায়ারে হত্যার একটি ধারা বেশ চলমান ছিল আমেরিকার স্যাংশনের আগে। এটিও সবারই জানা; কিন্তু অনেকেরই অজানা, প্রকাশ্যে হত্যার রাষ্ট্রীয় বিধানও আমাদের দেশে ছিল, যা এই সেদিনের বিষয়। তবে মানুষ নয়, হত্যা করা হতো বেওয়ারিশ কুকুর। কুকুর হত্যা করা ছিল পৌরসভার আইনগত দায়িত্ব। প্রথমদিকে এই কর্ম করা হতো ঘুমন্ত অথবা বিশ্রামরত কুকুরের মাথায় আঘাত করে। পরে বিষয়টি একটু ‘মানবিক’ করা হয়েছে। নিধনের জন্য কুকুর ধরে ইনজেকশন পুশ করা হতো। তবে এতে কুকুর পুরো মরত না। হয়তো মশা মারা ওষুধের মতো কুকুর মারার ওষুধেও ভেজাল ছিল। ফলে ময়লার স্তূপে ফেলে দেওয়া কুকুরগুলো যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মরত। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কুকুর নিধনের তাণ্ডব বন্ধ হয়েছে। শুধু তাই নয়, কুকুর মারলে জেল-জরিমানারও বিধান করা হয়েছে।
আমাদের দেশের কুকুর নিধনের মতোই ১৫৭৪ সাল পর্যন্ত ইস্তাম্বুলের রাজকুমারদের হত্যা করার ধারা অব্যাহত ছিল। ইতিহাস বলে, অটোমান সাম্রাজ্যে নতুন সুলতান সিংহাসনে বসার পর ভাই হত্যার বিধান বিলুপ্ত করার পর থেকে অটোমান সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলার সূচনা হয়। একপর্যায়ে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ, যা চলেছে একটানা ২০ বছর। এতে সাম্রাজ্যের ভিত ফোকলা হয়ে যায়। উইপোকার কবলে পড়া কাঠের মতো। অটোমান সাম্রাজ্য চলে যায় ধ্বংসের দিকে। এর ধারাবাহিকতায় অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। দেশটিতে জেকে বসে নানান বিদেশি শক্তির উপদ্রব। এদিকে আমাদের দেশে কুকুর নিধন বিধান রহিত হওয়ার পর সায়মেয় দলের উপদ্রব কী পরিমাণ বেড়েছে, তা কমবেশি সবাররই জানা; কিন্তু এই বিধান তো আর অমান্য করার নয়। হয়তো, অটোমান সাম্রাজ্যে যুবরাজ এবং আমাদের দেশে কুকুর নিধনের সনাতনী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই সারা দেশে সাংবাদিক নিধনের ধারা চলে আসছে। যার সাম্প্রতিক অন্যরকম সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ। দুজন সহযোগী অধ্যাপকের নেতৃত্বে একদল সাংবাদিককে পেদিয়ে বৃন্দাবনে পাঠানো ব্যবস্থা করেছে। আর একটু সময় পেলে অথবা আক্রান্ত মেষরাশির সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে প্রতিবাদী হলে তাদের হয়তো স্বর্গ অথবা নরকের টিকিট হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারত; কিন্তু পরিস্থিতি সে পর্যন্ত যায়নি। বরং রহস্যজনক কারণে সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে মানিয়ে চলার মানসিকতা দেখানো হয়েছে। যেমন আরও অনেক কিছু মানিয়ে নেওয়ার অনুশীলন চলছে। ফলে কে কোথায় কখন সাংবাদিক পিটিয়েছে অথবা হত্যা করেছে তা নিয়ে হয়তো কোনো প্রতিক্রিয়া বা প্রতিকার প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়। তবে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কবরের নীরবতার অন্যরকম বাস্তবতা নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
সারা দেশে সাংবাদিকদের বিষয়ে যা ঘটছে, তাকে হয়তো অটোমান সাম্রাজ্যের যুবরাজ হত্যা অথবা রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এক বা একাধিক কেন্দ্র থেকে। হতে পারে, এই প্রকল্পের আওতায় মাঠপর্যায়ে একদল মানুষের উপদ্রব চলছে—যারা মোটেই সাংবাদিক নন। এবং চাইলেও তাদের সাংবাদিক বানানোর উপায় নেই। উল্লুক তো ঘোড়া হওয়ার নয়। আর ওপরের দিকে যারা সাংবাদিক নেতা হিসেবে আসীন, তাদের অনেকেই রাজনীতির প্রকাশ্য লেজুড় অথবা নানান ধরনের ব্যবসায়ী। এদিকে জানা কথা, অনেক মালিক গণমাধ্যমকে ঢাল এবং প্রাপ্তির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন। ফলে গণমাধ্যমের কণ্ঠ প্রতিনিয়ত ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার এই ভয়াবহ দুর্যোগে নিশ্চয়ই অন্ধকারের শক্তি কেন্দ্রগুলো বগল বাজাচ্ছে। বলা বাহুল্য, সাংবাদিক নিধন ও গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার ধারা আখেড়ে মোটেই সুফল বয়ে আনবে না। বরং চলমান ধারা চলতে থাকলে পরিণতি সব পক্ষের জন্য ভয়াবহ হতে বাধ্য। তখন হয়তো আর সামলানো যাবে না!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন