মারিয়া বিনতে আহসান হাবিব
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২৫, ০৭:৫৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

পৃষ্ঠাসংখ্যা নয়, মান মূল্যায়ন জরুরি

পৃষ্ঠাসংখ্যা নয়, মান মূল্যায়ন জরুরি

শিক্ষার কিছু কিছু পদ্ধতি বা রীতি সময়ের ধারায় এমনভাবে স্থায়ী হয়ে ওঠে যেন সেগুলোর যৌক্তিকতা আর তেমন কেউ খুঁজেই দেখেন না। পরীক্ষায় দীর্ঘ লেখা এমনই একটি চর্চা। এটি পরিণত হয়েছে এক ধরনের প্রতিযোগিতায়, যেখানে পৃষ্ঠাসংখ্যা বা পরিমাণ হয়ে উঠছে মানের প্রতীক। একটি প্রশ্নে কতটা বিশ্লেষণ করা উচিত, সেটির ওপর নয় বরং কতটা লেখা উচিত, সেটির ওপরই যেন মূল্যায়নের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। তা না হলে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার পরিবর্তে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে গড়ে তোলে সেই কাঠামোয়, যেখানে ভাবনার গভীরতা নয়, বরং পৃষ্ঠাসংখ্যাই হয়ে ওঠে দক্ষতার পরিমাপ।

বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হওয়া উচিত বিশ্লেষণ ও সৃজনশীলতার কেন্দ্র। যেখানে মূল্যায়নের ভিত্তি হওয়া উচিত বোধের গভীরতা, বিশ্লেষণের সামর্থ্য এবং ভাব প্রকাশের দক্ষতা; কিন্তু লেখার দৈর্ঘ্যের অতিমূল্যায়ন কখনো কখনো হয়ে দাঁড়ায় সেই গভীরতার প্রতিবন্ধক। শিক্ষার্থীরা তখন চিন্তার বিস্তার নয় বরং কলমের গতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

শিক্ষকরাও এ ব্যবস্থার অংশ। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই হয়তো এমন অনুশাসন ভাঙার চেষ্টা করেন, ছাত্রছাত্রীকে পরামর্শ দেন, নিজের মতো করে ভাবতে, লিখতে; কিন্তু পুরো কাঠামো যখন সংখ্যাভিত্তিক ধারার মধ্যেই রচিত, তখন সেই চেষ্টাগুলোও সীমিত হয়ে পড়ে। পরীক্ষার নম্বর বিভাজন, টেবুলেশন শিট, ফলাফলের চাপ, সব মিলিয়ে হয়তো অনেক শিক্ষক নিজের মাপকাঠি বাস্তবায়নের সুযোগ পান না। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে ‘নিজের ভাষা’ দিয়ে লেখার যে বার্তা পৌঁছায়, তা হয়ে ওঠে এক ধরনের সুদূরপরাহত আহ্বান, যার বাস্তব প্রতিফলন স্পষ্ট হয় না।

লেখার দৈর্ঘ্য যদি মূল্যায়নের প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে, তবে আশঙ্কা থেকেই যায় শিক্ষার্থীদের মান যাচাই ভিত্তি নিয়ে, তা কি মেধা, নাকি পৃষ্ঠা সংখ্যায়? প্রশ্ন হচ্ছে, উপলব্ধিই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য নাকি লেখার দৈর্ঘ্যে নিহিত, নাকি বিশ্লেষণের গভীরতায়? এমন ব্যবস্থার মাধ্যমে লেখার পরিমাণকে মূল মাপকাঠি না বানিয়ে, লেখার অর্থপূর্ণতা ও ভাবনার গুণমানকে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব। শিক্ষা কখনোই শুধু লিখনের দৈর্ঘ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি একসময় অভ্যাসে রূপ নেয়, আর সেই অভ্যাস যখন প্রশ্নহীন হয়ে পড়ে, তখনই চিন্তার পথে বাধা তৈরি হয়।

আমরা যদি ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীল, বিশ্লেষণে উৎসাহী ও আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে চাই, তবে আমাদের চাই এমন একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি, যেখানে ‘লিখছি কতটা’ নয় বরং ‘ভাবছি কতটা’ ও ‘সংক্ষেপে প্রকাশ করতে পারছি কতটা’ সেটাই হয়ে উঠবে বিচারযোগ্য। এই একমুখী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন সমন্বিত কিছু পদক্ষেপ। বিকল্প বলতে যা বোঝাতে চাই, তা শুধু নতুন কিছু চালু করা নয়, বরং বর্তমান ব্যবস্থাকে ভেতর থেকে পুনর্বিবেচনার সুযোগ সৃষ্টি করা।

মূল্যায়ন কাঠামোয় ‘বিশ্লেষণ’, ‘প্রাসঙ্গিকতা’ এবং ‘স্বচ্ছতা’র মানদণ্ড স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। প্রশ্নপত্রে নির্ধারিত শব্দসীমা বা কাঠামোগত দিকনির্দেশনা যুক্ত করা যেতে পারে, যেন শিক্ষার্থীরা জানে কীভাবে সংক্ষিপ্ত অথচ যথাযথ উপস্থাপনায় গুরুত্ব দিতে হবে। মূল্যায়নের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যামূলক নোট, কেস অ্যানালাইসিস বা অল্প কথায় যুক্তিনির্ভর উপস্থাপনায় প্রশিক্ষণ চালু করা যেতে পারে। পরীক্ষার বাইরে ছোট ছোট ইন-ক্লাস রিভিউ, গ্রুপ ডিসকাশন বা মৌখিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকলে, লেখা ছাড়া অন্যান্য ভাবনার প্রকাশও মূল্যায়নের আওতায় আসবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—বিষয়গুলো যেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে নীরব বোঝাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে; বরং পাঠক্রম ও মূল্যায়ন নীতিতেই প্রতিফলিত হয়। পরীক্ষা আসলে একটি আয়না, যেখানে প্রতিফলিত হয় একজন শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি, উপলব্ধি ও চিন্তার ভঙ্গি। এ আয়নাটিকে যদি আমরা কুয়াশায় ঢেকে ফেলি অযৌক্তিক কিছু রীতিতে, তাহলে সেখানে স্পষ্ট কোনো চিত্র ফুটে ওঠে না। শিক্ষার উচ্চতায় পৌঁছাতে চাইলে আমাদের এসব ‘অনুচ্চারিত চর্চা’ বা প্রচলিত ধারা নিয়ে ভাবতে হবে। সরাসরি দোষ নয় বরং নীরব মিথগুলোর দিকে আলো ফেলাই এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা তখনই অর্থবহ হয়ে ওঠে যখন তা লিখন নয়, চিন্তার জন্ম দেয়।

মারিয়া বিনতে আহসান হাবিব

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শোকজের জবাবে যা বললেন ফজলুর রহমান

শ্বশুরের বিচারপতি হওয়া নিয়ে সমালোচনা, ব্যাখ্যা দিলেন সারজিস

কর্মক্ষেত্রে প্রকৌশলীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি আইইবির

রাকসু নির্বাচন : মনোনয়নপত্র বিতরণের সময় বাড়ল, পেছাবে ভোটের তারিখ

এসএ২০ লিগের নিলামে বাংলাদেশের ২৩ ক্রিকেটার

জবি বাংলা বিভাগের এক শিক্ষককে বহিষ্কার, ক্যাম্পাসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা 

ছোট পর্দায় আসছে জনপ্রিয় তুর্কি সিরিজ ‘সুলতান আব্দুল হামিদ’

অবৈধ মোবাইল দিয়ে বন্দিরা আমাকে কল করেন : কারা মহাপরিদর্শক

বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশি প্রযোজকের সিনেমা

শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে : শামা ওবায়েদ 

১০

অভিজ্ঞতা ছাড়াই চাকরি দিচ্ছে রকমারি ডটকম, বেতন ৩০ হাজার

১১

জীবিকার তাগিদে বের হয়ে প্রাণ হারালেন রফিকুল

১২

হঠাৎ অসুস্থ একই স্কুলের ২২ ছাত্রী

১৩

কয়েকটি ইসলামি দলের সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে : সালাহউদ্দিন 

১৪

দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোয় পরিবহনমন্ত্রীকে জরিমানা!

১৫

নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে হামলাকারীদের কী সাজা হতে পারে

১৬

গকসু নির্বাচন : প্রথম দিনে ১৩টি মনোনয়নপত্র বিতরণ

১৭

ববির আবেগঘন পোস্ট

১৮

খুলনায় নদী থেকে বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার

১৯

প্রয়োজনে কেয়ামত পর্যন্ত অডিট বন্ধ থাকবে : এনবিআর চেয়ারম্যান

২০
X