বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খালি করার পর সরকার ভেবেছিল আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু তারা ভুল করেছিল হিসাবের অঙ্কে। ১৮ জুলাই সকালেই ঢাকার রাজপথে নামে এক নতুন সুনামি—বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, নর্থ সাউথ, আইইউবি, এআইইউবি, নর্দার্ন, মাইলস্টোন—আরও জানা-অজানা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একযোগে রাস্তায় নামে। তারা গরম, ধুলোমাখা রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকে: ‘গণহত্যার বিচার চাই!’ গলায় ঝোলানো আইডি কার্ড, কাঁধে ব্যাগ, মাথায় পতাকা—কিন্তু বুকের ভেতর জ্বলছিল আগুন। অগ্রজদের সঙ্গে স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছোট ভাইবোনেরা রাস্তায় নেমে আসে। এদের অনেকেই আর ঘরে ফেরেনি। মুগ্ধ, পানি বিলাতে বিলাতে মাথায় গুলি খেয়ে শহীদ হয়। ১৭ বছরের কিশোর ফাইয়াজ শহীদ হয় ধানমন্ডিতে। উত্তরা, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। দুপুর থেকে হেলিকপ্টার থেকে কাঁদানে গ্যাস আর গুলিবর্ষণ শুরু হয়। বাসার ভেতর, ছাদে, মায়ের কোলে শিশুরাও মারা যায়। এই শহর, যে শহর একদিন ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল, আজ তারই আকাশ থেকে জালিম সরকার নামিয়ে আনে যুদ্ধ। ঢাকার প্রতিটি মোড়ে, বাসস্ট্যান্ডে, গলির মাথায় ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ। সান্ধ্য আইন জারি করা হলো। এর কিছু পরেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। আন্দোলন এবার শুধু রাজপথে নয়—প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে মিশে যায়।
সন্তানদের লাশের সারি দিনে দিনে লম্বা হচ্ছিল। কোনোটি বাসার সামনে পড়ে ছিল, কোনোটি হাসপাতালের বারান্দায়, কোনোটি রাস্তায়, কোনোটি চুপচাপ কবরে চলে গেছে—কোনো ঘোষণা ছাড়া, বেওয়ারিশ পরিচয়ে। ডানদিকে লাশ, বাঁদিকে গ্রেপ্তার আর মাঝখানে নিঃশব্দে রক্ত চুইয়ে পড়া শহর। শিশু, কিশোর, যুবক—যারাই স্লোগান দিয়েছিল, তাদের তালিকা তৈরি করে তুলে নেওয়া হচ্ছিল। রাতে রিকশা থামিয়ে ব্যাগ তল্লাশি, বাসা থেকে ঘাড় ধরে ছেলে ধরে নিয়ে যাওয়া, ডিবি অফিসে পেটানোর পর মিডিয়াতে নাটক—‘তারা নিজের ইচ্ছায় আন্দোলন স্থগিত করেছে।’ এই ছিল রাষ্ট্রের নাট্যশালা, যেখানে সত্যকে পিষে মিথ্যার রক্ত ছিটানো হতো। তাদের পরিবার কাঁদছে আর মিডিয়াতে চলছিল অনুষ্ঠান: ‘আন্দোলন দেশের উন্নয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’
সারা দেশে তৈরি হলো এক অদ্ভুত জাগরণ। দোকানদার বলল, ‘ভাই, আমার ভাইও মারা গেছে।’ রিকশাচালক বলল, ‘মামারা, আপনাদের সাথে থাকুম, যা লাগে বইলেন।’ শিক্ষকরা এসে বললেন, ‘তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা পেছনে থাকব।’ মা গ্রেপ্তার হওয়া সন্তানকে বলে, ‘বাবা ভয় নেই।’ বোন দাঁড়িয়ে পড়ে পুলিশের গাড়ির সামনে, ‘আমার ভাইকে নিতে দেব না।’ তার মধ্যেও দালাল সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের খেলা থামায়নি। প্রতিদিন টকশোতে বসে বলা হচ্ছিল, ‘বিদেশি এজেন্ট, জামায়াত, রাজাকার, ষড়যন্ত্র!’ আন্দোলনের যে শিশু মারা গেছে, তাকেও ‘চক্রের অংশ’ বলা হলো। হাসিনার মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে অভিনয়; তিনি গিয়েছিলেন ভাঙা কাচের ছবি তুলতে।
প্রতিদিনের সংবাদপত্র ভরে উঠল লাশের ছবিতে। তবু মানুষ থামেনি। শুধু ছাত্র না—শিক্ষক, কৃষক, কবি, মা, বোন, প্রবাসী ছাত্র, ছিন্নমূল, হকার; সবাই এসে দাঁড়িয়েছিল একই শব্দে: ‘এই রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’ প্রবাসীরা তাদের কষ্টার্জিত মুদ্রা পাঠানো বন্ধ করে অভিনব প্রতিবাদ জানায়। সামাজিকমাধ্যমে লাল রং হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রকাশ।
এই দমনযজ্ঞের মধ্যে এক আশ্চর্য প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল শহরের দেয়ালজুড়ে। রংতুলি হাতে শিক্ষার্থীরা সব দেয়াল ভরিয়ে তুলছিল গ্রাফিতিতে। কোথাও শহীদদের নাম, কোথাও রক্তে লেখা প্রতিবাদ, কোথাও মুখোশ খুলে ফেলার আহ্বান। তাদের স্লোগান, কবিতা, প্রশ্ন—সবকিছুই ফুটে উঠেছিল রঙে, বাক্যে, লাল কালিতে। দেয়ালে লেখা হয়, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না।’ এ দেয়ালগুলো হয়ে উঠেছিল সত্যিকারের সংবাদপত্র, এ লাইনগুলো হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের মিথ্যার জবাব। এ তরুণরাই বুঝিয়ে দিয়েছিল—যেখানে শব্দ চাপা পড়ে, সেখানে রং কথা বলে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীদের ওপর নেমে আসে আরেক দফা নির্যাতন। মাঠের ছেলেরা গুম হয়, কর্মীদের উঠে বসার আগেই পেটানো হয়। আইনজীবীরা বিবৃতি দেন—‘রাষ্ট্র আইনের তোয়াক্কা করছে না।’ গ্রেপ্তার এড়াতে আমার আর বাসায় থাকা হয়ে উঠল না—থাকলাম পথে পথে, পরিবার ছেড়ে, এক বন্ধু থেকে আরেক বন্ধুর বাসায়, মোবাইল বন্ধ করে। আমার অপরাধ—আমি প্রশ্ন করেছি, আমি লিখেছি, আমি স্বপ্ন দেখিয়েছি। আর বিশ্ব? জাতিসংঘ বলল, ‘এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত জরুরি।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলল, ‘বাংলাদেশের জনগণের পাশে আছি।’ তবু কেউ হাসছিল, কেউ অস্বীকার করছিল, কেউ ব্যঙ্গ করছিল, কেউ বলছিল—‘সবাই সন্ত্রাসী।’
আন্দোলন পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। ৪ আগস্ট সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথে একটাই আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল—‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই!’ হাজার হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছিল শাহবাগ, টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কার্জন হল। শহীদ মিনার থেকে ঘোষণা এলো, ‘এই রক্তের পাহাড় পেরিয়ে আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ এদিনেই প্রথম ঘোষণা আসে—‘ঢাকামুখী লংমার্চ’। প্রথমে বলা হয় ৬ আগস্ট হবে, কিন্তু বিকেলের পরপরই বিক্ষোভকারীদের চাপ, জনতার উত্তেজনা ও শহীদদের সংখ্যার ভারে সিদ্ধান্ত হয়—লংমার্চ হবে পরের দিনেই, ৫ আগস্ট। ঢাকায় বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল এক নীরব প্রতিজ্ঞায়— পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত পিছু হটা নয়। ‘বুকের ভেতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি, গুলি কর।’
৫ আগস্ট সকাল বেলা। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সে মহেন্দ্রক্ষণ। ঢাকা শহর যেন নিঃশ্বাস আটকে বসে ছিল। সবাই জানত—কিছু একটা ঘটবে; একটা বিস্ফোরণ, কিংবা রক্তস্নান। জরুরি বার্তায় ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেত্রী ঘোষণা দিয়েছিল: ‘সাত মিনিটেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’ ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন: ‘আমি মার্চ টু ঢাকা হতে দেব না।’ গণভবন ঘিরে যুদ্ধের প্রস্তুতি, মেশিনগান বসানো। ঢাকায় ঢোকার প্রতিটি মুখে রণসজ্জা। কিন্তু মানুষ তো ভয় জয় করে ফেলেছে। তারা আসছিল চারদিক থেকে—পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ—লাখে, লাখে। তারা ছিল নিরস্ত্র, সংকল্পে অটল। তারা হেঁটে চলেছিল গণভবনের অভিমুখে—শান্ত, অবিচল। ‘তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়; সেই ভয়ের টুঁটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়।’
‘শেখ হাসিনা পালায় না।’ এ কথাটাই তো তিনি নিজে বলেছিলেন মাত্র কিছুদিন আগে—জনসমক্ষে, দম্ভভরে। কিন্তু ৫ আগস্ট দুপুরে সেই শেখ হাসিনাই পালিয়ে গেলেন। কোনো ক্যামেরা ছিল না, ছিল না কোনো ঘোষণা—শুধু তাড়াহুড়ো, আতঙ্ক, আর অপমান। যে জালিম ষোলো বছর ধরে দেশের গলার ওপর পা দিয়ে রেখেছিলেন—তিনি পালালেন, পণ্য বহনের বিমানে করে, ভারতে। এক সংক্ষিপ্ত বার্তা চোখের পলকে চাউর হয়ে যায়—‘শেখ হাসিনা পালাইছে।’ শুনে যেন শহরের আমেজই বদলে গেল। মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ল—কেউ হাসল, কেউ কাঁদল, কেউ চিৎকার করল। মিষ্টির দোকান নিমিষে খালি। অন্তহীন দুঃস্বপ্ন যেন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। তবু সবখানে শেষরক্ষা হয়নি। যাত্রাবাড়ী, চানখাঁরপুল, সাভার—এসব জায়গায় কিছু ‘নির্বোধ বাহিনী’ শেষ মুহূর্তে গুলি ছুড়েছিল। নিহত হন অনেকেই—তাদের রক্তেও ভিজে থাকে সেই দিনের পতাকা।
কিছুই থামাতে পারেনি জেগে ওঠা বিজয়ী জনতাকে। তারা ঢুকে পড়ে গণভবনে। আরেক দল ছুটে যায় সংসদ ভবনের দিকে। তারা বলে—এই সংসদ আর কেবল একটি দলের নয়, এখন এটি পুরো জাতির। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ছাদে দেখা যায় পতাকা ওড়াচ্ছে হাজারো তরুণ। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ঢাকার বিভাগীয় অফিস—সবকটি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। কে আগুন দিল? আগুন দিয়েছিল গুম হয়ে যাওয়া বাবার পুত্র, সন্তান হারানো বাবা, বন্ধু হারানো কিশোর, সহোদর হারানো ভাই।
‘শেখ হাসিনা পালাইছে।’ এ শব্দটি শুধু বিজয়ের উল্লাস নয়, এটা একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষার ভারমুক্তি। এ ইতিহাস কেউ মুছতে পারবে না। এখন সময় এই ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার, শহীদদের নাম রক্ষার, প্রতিরোধের স্মারক গড়ে তোলার। আমি এই রাষ্ট্রের সেই শিক্ষক, যাকে বলা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহী। আজ আমি বলছি—এই রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক ছিল সেই সব তরুণ-তরুণী, যারা চোখ তুলে বলেছিল—‘তুমি কে, আমি কে? বিকল্প! বিকল্প!?’ (শেষ)
লেখক: অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন