এম এ আজিজ
প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:৫২ এএম
আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যত কথন

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যত কথন

বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার নোবেল। এ পুরস্কার যারা পান তারা বিশ্বে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনের জায়গাটিই পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিশ্বের আরও কয়েকজন নোবেল বিজয়ীকে অন্যায় বা প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিচারের মুখোমুখি হওয়া নোবেল বিজয়ীরা হলেন বাংলাদেশের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বেলারুশের অ্যালেস বিলিয়াতস্কি, মিয়ানমারের অং সান সু চি, চীনের লিউ শিয়াবো ও জার্মানির ভম অজিয়েস্কি প্রমুখ।

অবশ্য অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে বিশ্বভারতীর ১৩ ডেসিমেল জমি দখল থাকার অভিযোগ আছে। কিন্তু ভারতের একটি আদালত তাদের দেশে একজন নোবেলজয়ী জাতীয় সম্পদ বিবেচিত হওয়ায় তার দখলে থাকা জমি নিয়ে জারি করা বিশ্বভারতীর নোটিশের স্টে অর্ডার দিয়েছে। এদিকে বিশ্বের শতাধিক নোবেলজয়ীসহ ১৭০ জনের বেশি বিশ্বনেতা শেখ হাসিনার প্রতি খোলা চিঠি দিয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলায় স্থগিত চেয়েছেন।

ওই চিঠির প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ১৭১ বিশিষ্টজন এবং ৫০ জন সম্পাদক। ড. ইউনূসের সঙ্গে ‘বিচারিক হয়রানি’ হচ্ছে বলে মন্তব্য করে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেননি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। এরই মধ্যে এমরান ভূঁইয়াকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেন।

গত ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্রমাগত ভয়ভীতি ও হয়রানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ড. ইউনূস প্রায় এক দশক ধরে হয়রানি ও ভয়ভীতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে দুটি আলাদা বিচার চলছে, যাতে তার কারাদণ্ড হতে পারে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে আর দ্বিতীয়টি দুর্নীতির অভিযোগে। ভলকার তুর্ক বলেন, ‘যদিও প্রফেসর ইউনূস আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু আমরা উদ্বিগ্ন যে, প্রায়ই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তার বিরুদ্ধে যেভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তাতে তার আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি ন্যায্য বিচারের অধিকার ঝুঁকিতে রয়েছে।’

এখন আমরা বুঝতে চাই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী কেন এত আলোচিত। এর প্রধান কারণ সচেতন জনগণের মধ্যে নীরবে বেশ আলোচনা চলছে দেশে বর্তমানে রাজনীতিতে যে টানাপোড়েন চলছে, তাতে যদি রাজনৈতিক দলগুলো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারে, তাহলে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কোনোভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আবির্ভাব ঘটতে পারে। সেটা ঠেকাতেই তাকে বিতর্কিত করার অংশ হিসেবে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে মোটাদাগে যে সাতটি কাল্পনিক অভিযোগ সবার নজরে এসেছে, সেগুলো আলোচনা করে দেখতে পারি।

ড. ইউনূসকে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকার সমর্থক কেউ কেউ বলেন সুদখোর। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি। পৃথিবীর কোনো এনজিও পরিচালিত ব্যাংক বা কমার্শিয়াল ব্যাংক সুদ দেওয়া-নেওয়া ছাড়া পরিচালিত হয় না। গ্রামীণ ব্যাংক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, যে প্রতিষ্ঠানটি সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং জনগণের টাকায় চলে। গ্রামীণ ব্যাংক যে সুদ নিয়েছে, তার জন্য যদি সুদখোর বলা হয়, তাহলে ড. ইউনূস নয়, সুদখোর বলতে হবে সরকার এবং জনগণকে। সুতরাং ড. ইউনূস সুদখোর এটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করেছেন। তাই তাকে ‘পদ্মা সেতু থেকে টুস করে ফেলে’ দেওয়ার কথা উঠেছিল। বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতে দুর্নীতির অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে ‘টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড’ উপস্থাপন করে। অন্টারিও সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ‘টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড’ আদালতে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মামলাটি খারিজ করে দেন। এ তথ্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কল্যাণেই আমরা জেনেছি। এখানে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ অলীক।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি কর ফাঁকি দিয়েছেন। তার নিজের অনুদানের টাকায় দুটি ট্রাস্ট গঠন করেছেন। তার আইনজীবী তাকে বলেছিলেন, অনুদানের টাকার কর লাগে না। এনবিআর বলেছে, অনুদানের টাকারও কর লাগবে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত আদালত রায় দেন ড. ইউনূসের অনুদানের টাকার কর ১২ কোটি টাকা। তিনি এ কর পরিশোধ করেছেন। এ ব্যপারে ড. ইউনূসের দায় কতটুকু?

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ, তিনি ১/১১-এর সময় প্রধান উপদেষ্টা হতে চেয়েছিলেন। রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন। জেনারেল (অব.) মইন উ আহমদের লেখা ‘জেনারেল মইনের বয়ানে ওয়ান ইলেভেন’ বইতে পাওয়া যায় ‘প্রথমে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তাতে রাজি হননি। তখন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ প্রস্তাব পেয়ে এগিয়ে আসেন।’

অন্যদিকে গবেষক-লেখক মহিউদ্দীন আহমেদ একটি লেখায় দুজন সেনা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লিখেছেন, মুহাম্মদ ইউনূস কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হওয়ার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার প্রধান কারণ ছিল এ সরকারের স্বল্পমেয়াদ। সে লেখার প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক ইউনূস বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ‘সেনাবাহিনীর প্রস্তাবে আমি কেন রাজি হইনি এ বিষয়ে যে কারণ তারা উল্লেখ করেছেন, তা একেবারেই কল্পনাপ্রসূত।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক সংকটে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছেন, তার মতামত জানাচ্ছেন, এটা ইতিবাচক। এ ছাড়া তিনি নিজে যখন বলেছেন যে রাজনীতিতে আসবেন না, তাই তার এই মতবিনিময় এবং মতামত দানে কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায় নেই বলেই মনে হয়।’

তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যক্রম দেখে প্রতিভাত হয়েছিল তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চেয়েছিলেন। ড. ইউনূস নিজে বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমার কাছে আসছে, সরকারের কেউ বা আওয়ামী লীগ যদি আমার কথা শুনতে চায়, তাহলে আমি সানন্দে রাজি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সংঘাত কমবে।’

যাহোক, ১/১১-এর সরকারের সব কাজ বৈধতা পেয়েছে এবং ১/১১ সরকারের সব কুশীলব সবরকম নিরাপত্তা পেয়েছে। তাহলে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘কোনো অভিযোগ আছে বলে কারও মনে হলেও’ কেন শুধু তিনিই অভিযুক্ত হবেন? কেউ ড. ইউনূসকে আলাদা করে দেখলেই সেটা হবে ‘প্রতিহিংসা’।

ড. ইউনূস দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন বলে ঢালাও অভিযোগ করা হয়। তিনি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। প্রবাসী আয়ে কর লাগে না। অবশ্য প্রবাসী আয়ের ওপর সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়। তিনি তা নেন না। এখানে ড. ইউনূসের অপরাধ কোথায়?

ড. ইউনূস হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনের সময় তাকে অনুদান দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। আমেরিকার রাজনীতিতে নির্বাচনে প্রত্যেক প্রার্থী বৈধভাবেই অনুদান নিয়ে থাকেন এবং প্রার্থীকে এই অনুদান কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়েছিলেন, নির্বাচনের পর সরকারকে সেই হিসাব দিতে হয়। সেখানে ড. ইউনূসের নাম আছে কি?

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে গ্রামীণ টেলিকমের ১৮ জন শ্রমিক, পরে আরও ১৮ জন শ্রমিক, পৃথকভাবে কোম্পানির পাঁচ শতাংশ লভ্যাংশের জন্য শ্রম আদালতে মামলা করেন। যেভাবে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করা হচ্ছে, তাতে বলাই যায় শ্রমিকদের মামলাগুলো ড. ইউনূসকে হয়রানি করার জন্য ফরমায়েশি মামলা। আদালতের রায় দিলে নিশ্চয়ই তিনি শ্রমিকদের প্রাপ্য টাকা বুঝিয়ে দেবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে এক লাখের ওপর রেজিস্টার্ড কোম্পানি আছে। তাদের মধ্যে কয়টা কোম্পানি তাদের লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের দেয়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে এত অলীক অভিযোগ, কিন্তু তিনি এগুলোর ব্যাপারে একটি কথাও বলছেন না। তিনি হয়তো কথা বললে এসব বিষয় জনমনে পরিষ্কার হয়ে যেত। আমার বিশ্বাস, বিশ্বের শতাধিক নোবেলজয়ীসহ ১৭০ জনের বেশি বিশ্বনেতা শেখ হাসিনার প্রতি খোলা চিঠি দিয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলায় স্থগিত চেয়েছেন, তারা হয়তো ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগের জবাব পেয়েছেন। তাই তো নোবেলজয়ীসহ বিশ্বনেতারা বলছেন, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিহিংসার শিকার। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সর্বশেষ যে মামলা দেওয়া হয়েছে, সেখানে তিনি যে ন্যায়বিচার পাবেন না, তার কিছু কিছু আলামত এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। আদালত কক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বের করে অনেকটা ক্যামেরা ট্রায়ালের আয়োজন করা হলে আইনজীবীর প্রতিবাদে সেটা আবার রেস্টোর করা হয়। আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, প্রত্যেক নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কোম্পানির পাঁচ শতাংশ লভ্যাংশ শ্রমিকদের পাইয়ে দেওয়ার পক্ষে দুদকের একজন আইনজীবী এখন যেভাবে সোচ্চার, আশা করি অন্য শ্রমিকদের বেলায় তার ভূমিকা এমনই উচ্চকিত থাকবে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তাপপ্রবাহ নিয়ে সতর্কবার্তা আবহাওয়া অধিদপ্তরের

বনাঞ্চল উজাড় করে মাছের ঘের

সরকার-নির্বাচন কমিশন চাইলে আ.লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারে : মঈন খান

শঙ্খের ভাঙনে বিলীন ধানি জমি, আতঙ্কে উপকূলবাসীরা

টোকিওর হোটেলগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ

পাক-ভারত উত্তেজনায় আইপিএল স্থগিত

গাছের ‘তেলে’ দৌড়াল ইঞ্জিন

আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে মঞ্চে জড়ো হচ্ছেন আন্দোলনকারীরা

ক্ষেপণাস্ত্র চালাল উত্তর কোরিয়া

জবি ম্যাথ ক্লাবের দায়িত্বে সিফাত ও নয়ন  

১০

পরোয়ানা নিয়ে সাজেদুলের বাড়ি যাওয়া এসআই প্রত্যাহার

১১

যুদ্ধ পাকিস্তান শুরু করেছে দাবি শেবাগের

১২

যমুনার চরে ফসলের বিপ্লব

১৩

স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা এখন জিয়া মঞ্চের গুরুত্বপূর্ণ পদে

১৪

রাশিয়ার ‘শ্যাডো ফ্লিটে’ খেপেছে যুক্তরাজ্য

১৫

৩০ ভারতীয় কামিকাজে ড্রোন ভূপাতিত, নিহত ২

১৬

বোমা আতঙ্কে কাঁপছিলেন আইপিএল চিয়ারলিডার, ভিডিও ভাইরাল

১৭

ছুটির দিনেও ঢাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’ 

১৮

ভয়ে ভারত ছাড়তে চাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা

১৯

পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো পিএসএল

২০
X