ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে, তার দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনামলে নানাভাবে এ দেশের মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছেন। গুম, খুন এবং আয়নাঘরে বর্বর নির্যাতনের পাশাপাশি ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে তিনি গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানি এবং জেলের ঘানি টানিয়েছেন। দেশের আইন, আদালত এবং প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের এমন নজির পৃথিবীতে বিরল। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির ৫০ লাখ সদস্যের প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ২৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। কয়েক ডজন এমনকি শত শত মামলার সম্মুখীন হচ্ছেন দলটির সক্রিয় নেতা ও সংগঠকরা। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীকে আন্দোলনের চেয়ে আদালতে হাজিরা ও মামলা চালানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থককে বিচারকের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। তবে বেশিরভাগের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্পষ্ট ও দুর্বল।
বিএনপি নেতাদের দাবি, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের প্রায় ৮০০ নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং ৪০০ জন গুম হয়েছেন। মানবাধিকারকর্মীদের অভিযোগ, মামলার আসামিরা মাসের পর মাস জেলে থাকেন, সেখানে নানা হয়রানির শিকার হন। ছুটির দিন ছাড়া বাকি দিনগুলোয় সকালে ঘুম থেকে উঠেই আদালতে আসতে হতো বিএনপি নেতাদের। আদালতে হাজিরা দেওয়া রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন (আলাল), বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমানের (শিমুল বিশ্বাস)। রিজভীর মামলা ছিল ১৮০টি। আলালের বিরুদ্ধে আড়াইশ আর শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ছিল দেড়শর বেশি মামলা।
বিএনপি নেতাদের আইনজীবীরা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় গাড়ি পোড়ানোসহ নাশকতার অভিযোগে করা মামলাগুলোর বিচার দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সারা দেশে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মামলা দেওয়া হয়েছিল, যা ‘গায়েবি মামলা’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, বিগত সরকারের আমলে গায়েবি মামলার হাত থেকে রেহাই পাননি লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, এমনকি শ্রমজীবী সাধারণ মানুষও। তবে আশার কথা এই যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিরোধী দলের নেতারা ছাড়া পেয়েছেন। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে করা মামলাও প্রত্যাহার করা হচ্ছে। খবরে প্রকাশ, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আট বছরে শ্রমিকনেতা ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল, সেগুলোর প্রায় সবই প্রত্যাহার হয়ে গেছে। এর ফলে অভিযুক্ত, অজ্ঞাতপরিচায় ৪৭ হাজার ৭২৮ জন মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তবে শ্রমিক হত্যার অভিযোগে গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানায় হওয়া একটি মামলা প্রত্যাহার হয়নি। ঢাকা ও গাজীপুর জেলার চার থানায় শ্রমিকনেতা ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল ৪৫টি। সবচেয়ে বেশি ১৫টি মামলা হয়েছিল ঢাকার আশুলিয়া থানায় আর ১৪টি হয়েছে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানায়। এ ছাড়া কোনাবাড়ী থানায় ১০টি, জয়দেবপুর থানায় ২টি, বাসন থানায় ২টি এবং টঙ্গী পশ্চিম থানায় ২টি মামলা ছিল। মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয় গত মাসে।
শ্রমিকদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারে আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ জানাই। সেইসঙ্গে আমাদের প্রত্যাশা, মামলাবাজির রাজনীতি বন্ধ হবে। অনাহুত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হবে না সাধারণ মানুষ।
মন্তব্য করুন