মাত্র কদিন আগে পিআইবির মহাপরিচালক কবি জাফর ওয়াজেদ ফেসবুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ইসলামিক জলসার আয়োজন করা হয়! যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চে স্বাধীনতার ডাক দেওয়া হয়, সেদিনই সেখানে ইসলামিক জলসা! যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সভাপতি, প্রধান অতিথি জেনারেল জিয়াউর রহমানের ডেপুটি এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তোয়াব, উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান ও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতরা। জলসার স্লোগান ছিল: ‘তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই, চাঁন-তারা পতাকা চাই’! জলসায় সমাগত মুসলিম জনতার নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ থেকে ছয় দফা দাবিনামা পেশ করা হয় রাষ্ট্রের প্রতি।
> দেশের নাম হতে হবে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’
> জাতীয় পতাকা বদলাতে হবে
> জাতীয় সংগীত বদলাতে হবে
> শহীদ মিনার ধ্বংস করতে হবে
> সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে
> ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ইসলামিক নেতৃবৃন্দের (মূলত স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের) বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলায় সেদিন মূলত পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্মিলনী হয়ে যায় ইসলামী জলসার আড়ালে। এখানে খেয়াল করা দরকার, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বাঙালি জাতির ভিত্তিমূলে আঘাত করত। যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই স্থানে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ইসলামী জলসা করেছিল। [সূত্র: ইত্তেফাক, ০৮.০৩.১৯৭৬; বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলাদেশি, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ড. আনিসুজ্জামান, ১৪৯-১৫০]
এই তোয়াব সাহেব সম্পর্কে কিছু বলা দরকার, এয়ার ভাইস মার্শাল মুহাম্মদ গোলাম তোয়াব বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান ছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে হত্যার পর শরীফুল হকের (ডালিম) সহযোগিতায় এম হামিদুল্লাহ খানের পরামর্শে তাকে পশ্চিম জার্মানি থেকে দেশে আনা হয়। এ কে খন্দকারকে সরিয়ে তাকে বিমানবাহিনীর প্রধান করা হয়। কর্নেল ফারুক রহমানের ছত্রছায়ায় ১৯৭৬ সালের ৩০ এপ্রিল বগুড়া সেনানিবাসে একটি অভ্যুত্থান ঘটে। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান কঠোর হাতেই এই বিদ্রোহ দমন করেন। অভিযোগ ওঠে, এয়ার ভাইস মার্শাল মুহাম্মদ গোলাম তোয়াব অভ্যুত্থানে জড়িত। কৌশলগত কারণে ১৯৭৭ সালে জোরপূর্বক অবসরে পাঠিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
অনেকে শুনলে অবাক হবেন—বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর খুনি সরকার শুধু জয় বাংলা, বাংলাদেশ বেতার, ৭ মার্চ নিষিদ্ধ করেনি। জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। তার প্রথম উদাহরণ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জাহিদুর রহিমের ওপর অমানসিক নির্যাতন। বেতারের সরকারি বাসভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়। কারণ বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ড. সনজিদা খাতুন, জাহিদুর রহিমকে দিয়ে যে কোনো অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়াতেন। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের জাতীয় সংগীত, আমাদের অহংকার। জাতীয় সংগীতের মূর্ছনায় আমাদের হৃদয়ের আবেগ যেন উথলে ওঠে। আমরা দেশের প্রতি এক অনাবিল ভালোবাসায় সিক্ত হই। ইউনেস্কোর মতে, পৃথিবীর মধুরতম সংগীতগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত একটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়ই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অনন্য সৃষ্টি, আমাদের হৃদয় ছোঁয়া প্রাণের সংগীত। কিন্তু সরকারি নথিপত্রে দেখা যায়, অন্তত তিনবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তিনবার নানা কারণে শেষ মুহূর্তে এ উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
জাতীয় সংগীত প্রথম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় খুনি মোশতাক সরকার। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়া-ফারুক-ডালিম চক্র রাষ্ট্রপতির আসনে বসায় খন্দকার মোশতাক আহমেদকে। ক্ষমতায় বসেই মোশতাক ‘বাংলাদেশ বেতার’ নাম পরিবর্তন করে রেডিও বাংলাদেশ করেন। ‘জয় বাংলা’ বাদ দিয়ে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ করেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথিতে দেখা যায়, ’৭৫-এর ২৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় অনুযায়ী জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে। কমিটিকে ‘এক মাসের মধ্যে পরিবর্তিত জাতীয় সংগীত’ প্রস্তাব করতে বলা হয়। দ্বীন মুহাম্মদ কমিটি তিনটি বৈঠক করে। তারা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ থেকে যে কোনো একটি জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেন ১ নভেম্বর। কিন্তু ক্যু-পাল্টা ক্যুতে ওই প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটে। ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকও নন। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন কবির লেখা গান জাতীয় সংগীত হওয়ায় মুসলিম উম্মাহ উদ্বিগ্ন। এই গান আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থি বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’ প্রধানমন্ত্রীর এই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনা জারি করে। এ সময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর এই উদ্যোগ সম্পর্কে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। [সূত্র : বাংলা ইনসাইডার]
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফা উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়। ২০০২ সালে শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ ডিও প্রধানমন্ত্রী বরাবর জমা দেন।
উল্লেখ্য, এরা দুজনই যুদ্ধাপরাধী এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এবং যথারীতি দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ স্বাক্ষরিত এই চিঠিতে দুজন যৌথভাবে বলেন, ‘সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন।’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এই অনুরোধপত্র সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক বিষয়টি ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ বলে সচিবের কাছে প্রেরণ করেন। সচিব জাতীয় সংগীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারবহির্ভূত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করেন ২০০২ সালের ১৯ আগস্ট। এরপর এ সম্পর্কে আর কোনো তৎপরতা নথিতে পাওয়া যায়নি। বেঁচে যায় আমাদের প্রাণের সংগীত। আমাদের চেতনার উৎস।
(২)
বিএনপির সমর্থকরা কখনোই কি ভেবেছেন—স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর সরকার কী করছে? এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাদের কেউ বলেছিলেন, বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় দেশটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক আচরণ করা উচিত এবং অবিলম্বে খাদ্য সহায়তা দেওয়া উচিত বলে সুপারিশ করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার। ১৯৭৪ সালের ১৩ জুন ওয়াশিংটনে পাঠানো রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার এক তারবার্তায় বলেন, “পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম আজ আমাকে তার সঙ্গে আলোচনার আমন্ত্রণ জানান। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই ‘জটিল’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি জানাতে বলেছেন যে, সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ পাটকল সংস্থা কিউবায় ৪০ লাখ চটের বস্তা রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক রপ্তানি হয়েছে। এমন রপ্তানি শুধু একবারের জন্যই। পিএল ৪৮০ সংক্রান্ত আইনি জটিলতা তাদের জানা ছিল না। এটা অজ্ঞতার কারণে ঘটেছে। নুরুল ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে কিউবায় রপ্তানি করতে দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে দেখা যায়। কারণ, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো নয়... আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, বাংলাদেশের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে আমাদের লাভটা কী। সোভিয়েত ব্লক থেকে তাড়াতাড়ি বের হওয়া তার জন্য দুরূহ। তবে বঙ্গবন্ধু মুজিব সরকার তার পররাষ্ট্রনীতিতে যেভাবে সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে, সেটা মার্কিন স্বার্থের অনুকূল। বাংলাদেশ এক বছর ধরে সব পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছে। ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি লেইনজেন মি. হোসেন আলীকে (যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) যেমনটা বলেছেন, তেমনি আমিও তাকে (নুরুল ইসলাম) বলি যে, এ নিয়ে প্রকাশ্য বিতর্ক করলে কোনো সুফল মিলবে না। এখন আমি মনে করি না যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বহীন এমন একটি কৃষিপণ্যের রপ্তানি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে কোনো ফায়দা পেতে পারি।” [মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড, মিজানুর রহমান খান, পৃষ্ঠা ২৪, ২৫]
বোস্টার ওই বার্তায় কিসিঞ্জার উত্থাপিত আইনি জটিলতার সমাধানও বাতলে দেন। তিনি যুক্তি দেন যে, “পাটজাত পণ্যের কোনো কৌশলগত গুরুত্ব নেই। তাই ওই আইনের আওতায় একে ‘অকৌশলগত কৃষিজাত পণ্য’ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।” ওই সময় ইউজিন বোস্টারের আরও কিছু উদ্যোগের প্রমাণ মেলে মার্কিন নথিতে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই হেনরি কিসিঞ্জারকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি।
কিসিঞ্জারের পাকিস্তানপ্রীতি ও বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষের চূড়ান্ত প্রমাণ মেলে—যখন দেখা যায়, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ প্রশ্নে তার নীতির ত্বরিত পরিবর্তন আনেন। বাংলাদেশ কিউবায় রপ্তানি করলেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে খাদ্য বিক্রি করবে মর্মে কিসিঞ্জার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সুপারিশ করবেন বলে মার্কিন নথিতে পাওয়া যায়। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে পাঠানো বার্তায় কিসিঞ্জার বলেন, “১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে পিএল ৪৮০ আইনের ওই ধারা সংশোধন করা হয়েছে। আমরা প্রেসিডেন্টের কাছে এই সুপারিশ রাখতে যাচ্ছি যে, তিনি যেন বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ নির্দিষ্ট করেন। বাংলাদেশ যদি কিউবায় রপ্তানি পুনরায় শুরুও করে, তাহলেও আমরা টাইটেল ওয়ান অব পিএল ৪৮০-এর অধীনে তার কাছে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারব। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে চার থেকে ছয় সপ্তাহের মতো সময় লাগবে। এই পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন আনলে আপনাকে তা অবহিত করব।” [মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড, মিজানুর রহমান খান, পৃষ্ঠা ২৯]
ইতিহাসে মনোযোগী পাঠকরা জেনে থাকবেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের ব্যাপারে একই রকম সহানুভূতিশীলতা প্রকাশ করেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি এ বাইরোড ১৬ আগস্ট ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় জানান, ভুট্টো বাংলাদেশের জন্য ৫০ হাজার টন চাল, এক কোটি গজ কাপড় (লং ক্লথ) ও ৫০ লাখ গজ সুতি কাপড় উপহার হিসেবে পাঠাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। [মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড, মিজানুর রহমান খান, পৃষ্ঠা ১০৬]
ইতিহাসের সব কথা আমলারা জানলেও বলবেন না। অবমুক্ত করা মার্কিন নথি থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৭৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে কিসিঞ্জার ভুট্টোর কাছে জানতে চান, ‘মুজিব কি টিকতে পারবেন?’
ভুট্টোর উত্তর ছিল, ‘আমি এতে সন্দেহ করি।’
কিসিঞ্জার: তখন কী হবে, সেনাবাহিনী আসবে?
ভুট্টো: হ্যাঁ। আর তখন তারা ক্রমবর্ধমানভাবে ভারতবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
আলোচনার একপর্যায়ে ভুট্টো আফসোস করে বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ফেডারেশন হিসেবে টিকে থাকলে কত ভালোই না হতো। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত জেনে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টো এই ফেডারেশন ধারণাটি নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পরিসরে জোর তৎপরতা চালান। বলাবাহুল্য, তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। [মার্কিন দলিল থেকে পড়ুন, সূত্র ৩০]
১৯৭৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ওই বৈঠকে ভুট্টো কিসিঞ্জারকে জানান, ‘চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চায় এবং এ নিয়ে তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। আমরা তাদের তা স্থগিত রাখতে অনুরোধ করেছি...’
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। তিনি ২০ আগস্ট ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারের সঙ্গে প্রথমবারের মতো বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে মোশতাকের কণ্ঠে যেন ভুট্টোর কথার (৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে কিসিঞ্জার-ভুট্টোর বৈঠকে) প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। ওই বৈঠকে মোশতাক বোস্টারকে বলেন, ‘যে সুযোগ একাত্তরে হারিয়েছি, তা এবার আর হাতছাড়া করা যাবে না।’ ওই বৈঠকে মোশতাক আশঙ্কা প্রকাশ করে ছিলেন ভারত যদি স্থল কিংবা আকাশপথে আক্রমণ করে, বিশেষ করে আকাশপথে হামলা চালায়, তাহলে তিনি প্রতিরক্ষাবিহীন হয়ে পড়বেন। [মার্কিন দলিল থেকে পড়ুন, সূত্র ৩১]
জিয়াউর রহমানের শাসনামল নিয়ে যে অভিযোগটি সবচেয়ে বেশি সেটি হচ্ছে, যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনৈতিক বিরোধিতা করেছিল কিংবা পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুগত ছিল, তাদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শাহ আজিজুর রহমান। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদ নেতা নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক সরকার জাতিসংঘে যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল তার অন্যতম সদস্য ছিলেন শাহ আজিজ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর দালাল আইনে গ্রেপ্তার করা হয় শাহ আজিজুর রহমানকে। পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করেছেন।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন