সনাতন তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যময় এবং উৎসবমুখর ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব অন্যতম। হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বলা হয়েছে—‘নিঃশেষদেবগণ শক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তিই হচ্ছেন দেবী দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, ‘দুর্গং নান্ময়তি যা নিত্যং সা দুর্গা সা প্রকীর্তিতা’ অর্থাৎ, দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন, তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা। আবার ‘দুর্গা’ নামক মূল গ্রন্থে উল্লেখ আছে—‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ’-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও ‘অ’-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়—শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। এভাবেই একাধিক গ্রন্থে দেবী দুর্গারস্বরূপ এবং সজ্ঞা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর কাঙ্ক্ষিত ফল লাভের আশায় শুদ্ধ একাগ্রচিত্তে আরাধনা করাই পূজা। অতএব, দুর্গাপূজা হচ্ছে দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান।
শাস্ত্র অনুসারে, আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষ এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গোৎসব পালন করা যায়। চৈত্র অর্থাৎ বসন্তকালের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা এবং আশ্বিন অর্থাৎ শরৎকালের দুর্গাপূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। কিছু কিছু পরিবার, স্থানে বাসন্তী দুর্গাপূজা পালন করা হলেও অধিকাংশ জায়গায় শারদীয় দুর্গাপূজা অধিক জনপ্রিয় এবং বেশি পালন করতে দেখা যায়। সাধারণত আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন পর্যন্ত পাঁচ দিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে আখ্যাত হয়। দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন; এ দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়, এ দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসেবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচ দিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। আবার কোনো কোনো স্থানে পনেরো দিনব্যাপীও দুর্গোৎসব পালন করার প্রথা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উৎসব মহালয়ার পূর্বপক্ষ অর্থাৎ পিতৃপক্ষের নবম দিন অর্থাৎ কৃষ্ণানবমীতে শুরু হয়ে থাকে। বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবাড়ীতে আজও এ প্রথা বিদ্যমান।
দুর্গাপূজা ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক দেশে উদযাপিত হয়ে থাকলেও এটি বিশেষ করে বাঙালিদের উৎসব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও ওরিশায় মহাসমারোহে পূজা করা হয়। বাংলাদেশসহ বর্তমানে পাশ্চাত্য, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশে হিন্দুরা অবস্থান করছেন, তারাও দুর্গোৎসব করেন। ২০০৬ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হলে ভয়েসেস অব বেঙ্গল সিজন নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে বিরাট দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন স্থানীয় বাঙালি অভিবাসীবৃন্দ ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। বর্তমানকালে দুর্গাপূজা দুভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক স্তরে ও সমষ্টিগতভাবে পাড়া স্তরে।
হিন্দুদের বিবিধ ধর্মগ্রন্থে দুর্গাপূজা প্রবর্তনের বিরল ইতিহাস রয়েছে। ব্রাহ্মবৈবর্ত পুরাণে লিখিত বিবরণ অনুসারে ব্রþহ্মা ও ইন্দ্রের ন্যায় ব্রþহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। এ সময়ে তিনি ভাবগত বীজ জপ করতেন, আহার ও শ্বাসগ্রহণ পরিত্যাগ করে ভূতলে একপদে দণ্ডায়মান থেকে একশ বছর ধরে ঘোর তপস্যা করেন। তপঃপ্রভাবে অত্যন্ত শীর্ণ হয়ে পড়লেও মনু কামক্রোধ জয় করে হৃদয়ে দুর্গাচিন্তা করতে করতে সমাধির প্রভাবে স্থাবর হয়ে পড়লেন। তখন দুর্গা প্রীত হয়ে তাকে দর্শনদান পূর্বক বরদান করতে চাইলে মনু দেবদুর্লব বর চাইলেন। মনুর প্রার্থনা শুনে দেবী দুর্গা বললেন, ‘হে মহাবাহো, তোমার প্রার্থনা সুসিদ্ধ হবে। আমি তোমাকে তোমার সকল প্রার্থনীয় বিষয় দান করেছি। বৎস, তোমার রাজ্য নিষ্কণ্টক হোক, তুমি পুত্রলাভ করো।
শ্রীশ্রী চণ্ডীমতে—দুর্গা ও দুর্গাপূজা-সংক্রান্ত কাহিনিগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও লোকমান্য হলো দেবীমাহাত্ম্যম্-এ বর্ণিত কাহিনিটি। দেবীমাহাত্ম্যম্ প্রকৃতপক্ষে মার্কন্ডেয় পুরাণের একটি নির্বাচিত অংশ। বাংলায় সাধারণত শ্রীশ্রী চণ্ডী নামে পরিচিত সাতশ শ্লোকবিশিষ্ট এই দেবীমাহাত্ম্যম্ পাঠ দুর্গোৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। এ গ্রন্থে দুর্গাকে নিয়ে চারটি কাহিনি প্রচলিত আছে, তার মধ্যে একটি কাহিনি দুর্গোৎসব প্রচলনের এবং অন্য তিনটি কাহিনি দেবী দুর্গার মাহাত্ম্যকীর্তন-সংক্রান্ত। কাহিনিগুলো হচ্ছে রাজা সুরথের কাহিনি, মধুকৈটভের কাহিনি, মহিষাসুরের কাহিনি ও শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনি।
শ্রী শ্রী চণ্ডীতে বর্ণিত দেবী দুর্গার কাহিনিগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় আবার গ্রন্থের মধ্যম চরিত্র বা দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লিখিত মহিষাসুর বধের কাহিনিটি। এ কাহিনি অনুসারে পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে একশবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রþþহ্মা এবং পরে তাকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণ সমীপে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনি শ্রবণ করে তারা উভয়ই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে তাদের মুখমণ্ডল ভীষণাকার ধারণ করল। প্রথমে বিষ্ণু, পরে শিব ও ব্রাহ্মার মুখমণ্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হলো। সে সঙ্গে ইন্দ্রাদিসহ অন্যান্য দেবতার দেহ থেকেও বিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হলো। সুউচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়া এই দেবী কাত্যায়নী বা দেবী দুর্গা নামে অভিহিতা হলেন।
হিন্দুদের এ ধর্মীয় গ্রন্থগুলো অনুযায়ী সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, যুগে যুগে বিভিন্নজন তাদের বিপদমুক্তির জন্য কল্যাণময়ী হিসেবে দেবীর পূজা করেছেন। দেবী দুর্গার পূজার মাহাত্ম্যের এসব ঘটনা পর্যায়ক্রমে ত্রিভুবনের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে গোকুলেও মানবজাতি তারই আলোকে আজ পর্যন্ত দুর্গোৎসব করছেন অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জাঁকজমকপূর্ণভাবে। বর্তমানে অধিকাংশ স্থানে দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি পূজিত হয়, সেটি দেবীর পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা ও মহিষাসুরমর্দিনী, তার ডানপাশের ওপরে ধনধাত্রী দেবী লক্ষ্মী (বাহন পেচক) ও নিচে সিদ্ধিদাতা গনেশ (বাহন মুষিক), বামপাশের ওপরে বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী (বাহন হংস) ও নিচে শৌর্যবীর্ষের প্রতীক কার্তিকেয় (বাহন ময়ূর)।
এবারের দুর্গোৎসব উপলক্ষে আমাদের একান্ত চাওয়া—উৎসবের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক। সবার অন্তরে শুভবোধ জাগ্রত হোক। কলুষতা-হানাহানিমুক্ত, নির্লোভ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠিত হোক। বিশ্ব হয়ে উঠুক বিষমুক্ত; নির্মল। মানুষ খোলা বাতাসে প্রাণভরে যেন নিতে পারে শ্বাস-নিঃশ্বাস। তবেই দুর্গাপূজা যথাযথ সার্থকতা লাভ করবে।
লেখক: কাজল আর্য, সাংবাদিক
মন্তব্য করুন