দীর্ঘকাল ধরেই রোহিঙ্গারা বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রহীন এক জাতি, যারা একদিকে মিয়ানমারের গণহত্যাকারী সামরিক শাসনের নিষ্ঠুরতার শিকার; অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নিয়ামকদের উদাসীনতার ফাঁদে আটকে আছে তারা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে এক নতুন এবং তুলনামূলকভাবে অনালোচিত বাস্তবতা জন্ম নিচ্ছে ‘ফোর ব্রাদার্স অ্যালায়েন্স’। দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান পরস্পরবিরোধী রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠছে এ জোট।
শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ জোটে একত্র হয়েছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি এবং রোহিঙ্গা ইসলামী মহাজ। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে এ এক ঐতিহাসিক বাঁক। বহু দশক ধরে এ গোষ্ঠীগুলো আলাদা আলাদা পথে চলেছে এবং বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষে জড়িয়ে রয়েছে। তারা পৃথকভাবে লিপ্ত থেকেছে নতুন যোদ্ধা জোগাড় করা, অর্থায়ন নিশ্চিত করা আর রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের প্রতিযোগিতায়। এতদিন তাদের পারস্পরিক শত্রুতা রোহিঙ্গাদের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক কণ্ঠ গড়ে তোলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন রাখাইন রাজ্যে নতুনভাবে রূপ নেওয়া সংঘাত পরিস্থিতির চাপে তারা প্রথমবারের মতো একটি একক মঞ্চে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলে লক্ষ করা গেছে।
সময়ের প্রেক্ষিতও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার দেশের বিশাল অংশে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যের বহু অঞ্চলে কার্যত স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে আরাকান আর্মি ও তার রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান। ইতিহাসে প্রথমবার, যে রাজ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সেই রাজ্য গণহত্যাকারীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। তবে এ অঞ্চলে ক্ষমতার শূন্যতা রোহিঙ্গাদের জন্য যেমন এক বিশাল সুযোগ, তেমনি এক গভীর বিপদের আশঙ্কাও বয়ে এনেছে।
ফোর ব্রাদার্স অ্যালায়েন্স বলছে, তাদের উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা এবং রাখাইনের সংঘাতের মধ্যে আটকে পড়া সাধারণ মানুষদের সুরক্ষা দেওয়া। আপাত দৃষ্টিতে সেটা মঙ্গলকর মনে হলেও, বাস্তবে এর অর্থ কী, তা নিশ্চিত করে এখনো বলা যাচ্ছে না। বাস্তুচ্যুতি ঠেকানোর নামে স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কিংবা রাজনৈতিক স্বীকৃতি দাবি করা হলে ভবিষ্যতে সেটা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও দীর্ঘায়িত করতে পারে। একই সঙ্গে এ ঝুঁকিও থেকে যায় যে, ফোর ব্রাদার্স অ্যালায়েন্স রাখাইন অঞ্চলের নতুন একক সামরিক শক্তিতে পরিণত হলে, হয়তো সেটা রোহিঙ্গা জনগণকেই আরেকবার সহিংসতার ফাঁদে ফেলে দেবে।
রোহিঙ্গা সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাস এক সতর্কবার্তা বহন করে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন এবং অনুরূপ গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী শিবিরগুলো থেকে পরিচালিত হতো। বহিরাগত সহায়তা থাকলেও তারা কখনোই কৌশলগত ঐক্যে পৌঁছাতে পারেনি। চোরাচালান, গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব এবং দলীয় বিভাজনেই জড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে তাদের। ২০১৬ সালে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির উত্থান কিছুটা নতুন গতি আনলেও, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সামরিক নিরাপত্তা কেন্দ্রগুলোতে তাদের হামলা সরকারি বাহিনীর গণহত্যামূলক অভিযানের পথ সুগম করে দেয়। যার ফলে হাজারো মানুষ নিহত হয় এবং সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
এরপর থেকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি তাদের নিজ জনগোষ্ঠীর কাছেই বিশ্বাস হারাতে শুরু করে। শরণার্থীশিবিরে খুন, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গাদের ইতিহাসে সশস্ত্র প্রতিরোধ বরাবরই রক্তপাত ও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে আছে। তাহলে এ নতুন জোটে কি আদৌ কোনো ভিন্নতা দেখা যাবে? সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউই।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। দেশটির একসময়ের সর্বশক্তিমান সামরিক বাহিনী, যেটা তাতমাদাও নামে পরিচিত—এখন দেশজুড়ে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বাধ্য হচ্ছে। উত্তরে কোচিন থেকে শুরু করে পূর্বের কারেন ও কারেননি—সব জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনী অভূতপূর্ব সমন্বিত আক্রমণে জড়াচ্ছে। বিশেষত আজ মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনীগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে আরাকান আর্মি। রাখাইন রাজ্যের ১৮টি উপজেলার মধ্যে ১১টিই এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। এ গোষ্ঠীর নেতা মেজর জেনারেল তোয়ান ম্রাত নাইং জাতিগত সমতার ভাষণ দেন, কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তার বিরুদ্ধে কোনো কোনো জায়গায় বেসামরিক রোহিঙ্গাদের হত্যা ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির অভিযোগ উঠেছে।
এ বাস্তবতার পটভূমিতে ফোর ব্রাদার্স অ্যালায়েন্সকে বিদ্রোহী দলগুলোর এক ধরনের বেঁচে থাকার কৌশল বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের লড়াইয়ে নিজেদের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ করতে চাইছে। বহু বছর ধরে তারা শান্তি-আলোচনায় প্রতিনিধিত্বহীন, আন্তর্জাতিক মঞ্চে অনুপস্থিত, এমনকি রাখাইনের নতুন প্রশাসনিক কাঠামোতেও তাদের কোনো স্থান নেই। এ জোট সম্ভবত সেই শূন্যতা পূরণের প্রচেষ্টা চালাবে। সে উদ্দেশ্যেই একটি ঐক্যবদ্ধ সামরিক ও রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে তারা। এ উদ্যোগকে তাতমাদাও আর উপেক্ষা করতে পারছে না।
তবুও ঝুঁকি বিপুল। রোহিঙ্গাদের জন্য সামরিকীকরণ কখনো নিরাপত্তা বয়ে আনেনি, বরং তাদের নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা আরও গভীর করেছে। সামরিক জান্তা সরকারও এ কারণেই বারবার রোহিঙ্গাদের ‘চরমপন্থি’ হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে। যদি এই নতুন জোটের বেসামরিকভাবে পরিচালনা করার মতো কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক শাখা না গড়ে ওঠে, তবে আবারও ঐতিহাসিক ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। অগণিত ছোট ছোট মিলিশিয়া গোষ্ঠীর বিস্তার ন্যায়বিচার বা নিরাপত্তা আনতে পারবে না, তা তাদের সদিচ্ছা যতই ভালো হোক না কেন।
যদি আরাকান আর্মি ও ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান সত্যিই ফেডারেল কাঠামো ও আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতিতে বিশ্বাস করে থাকে, তবে তাদের বেসামরিক রোহিঙ্গা জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে খোলামেলা সংলাপে আসতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে উভয়পক্ষেরই অসাধারণ সাহস প্রদর্শনের প্রয়োজন। আরাকান আর্মিকে বৃহত্তর মিয়ানমারের প্রাচীন রোহিঙ্গাবিরোধী বিদ্বেষকে নির্মূল করতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সশস্ত্র বিভাজনের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বমূলক দল গঠন করে জাতীয় ও স্থানীয় ব্যাপারগুলো নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে আলোচনার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
এ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। বাংলাদেশ, যে এখনো দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছে, তাদের নিরাপত্তাভিত্তিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। ঢাকার নীতিগুলো এতদিন শুধু প্রতিক্রিয়াশীল থেকেছে। কখনো দেখা গেছে রোহিঙ্গা শিবিরে কঠোর অভিযান, কখনো আবার অবাস্তব প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা। এর পরিবর্তে, বাংলাদেশের উচিত আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে এমন রোহিঙ্গা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সমর্থন দেওয়া, যারা একদিকে আরাকান আর্মির সঙ্গে, অন্যদিকে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের সঙ্গে কার্যকর সংলাপে অংশ নিতে পারে।
পাশ্চাত্য দেশগুলোর জন্যও এটি পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়ার উপযুক্ত সময়। ফোর ব্রাদার্স অ্যালায়েন্সের গঠন অসম্পূর্ণ হলেও সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত বহন করছে। রোহিঙ্গারা শুধু ভুক্তভোগী নয়; তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের সক্রিয় অংশীদার হতে চায়। এখন তাদের উপেক্ষা করা মানে হবে নতুন প্রজন্মকেও একই অবহেলা ও বঞ্চনার চক্রে ঠেলে দেওয়া। হয়তো এ জোট এখনো শান্তি ও ন্যায়বিচারের স্পষ্ট পথ দেখাতে পারেনি। কিন্তু এটি একটি মৌলিক সত্যকে উন্মোচিত করতে পেরেছে। সেটা হলো, রোহিঙ্গা সংকট রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ ছাড়া সমাধান করা সম্ভব নয়।
এ অংশগ্রহণ সশস্ত্র আত্মরক্ষার মাধ্যমে হবে, নাকি রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে—তা নির্ভর করবে আগামী কয়েক মাসে ফোর ব্রাদার্স অ্যালায়েন্স, আরাকান আর্মি এবং মানবাধিকারের পক্ষাবলম্বী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তের ওপর। এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের প্রকৃত অর্থে প্রয়োজন রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা। বিশ্ব যেন আরেকটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের অপেক্ষা না করে; রোহিঙ্গাদের তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার এটাই সর্বোৎকৃষ্ট সময়।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং জি-৭ আন্তর্জাতিক জোটের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা। নিবন্ধটি আরব নিউজ-এর মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন