[অষ্টম পর্ব]
এখানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ওই সময়কার ক্ষমতার ভিত্তি (Power Base) সম্পর্কে একটু দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। কারণ, আওয়ামী লীগ আসলে কোন শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করত? রাজনীতি বিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান দেখিয়েছেন যে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অর্থাৎ ১৬২ জনের মধ্যে ৭৭ জন ছিলেন আইনজীবী, চিকিৎসক ৭, শিক্ষক (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়) ১৬, সাংবাদিক ৫, ছাত্রনেতা ৩ জনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের মধ্যে ১৬০ জন মুসলমান, একজন হিন্দু ও একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের দুজন মাত্র পরাজিত হন। বাকি ১৬০ জন জয়লাভ করেন।
[Talukder Maniruzzaman; Radical Politics and Emergence of Bangladesh; Mowla Brothers; Dhaka-Pub-2018 (2nd Edition); Page-86]
পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে যে, পরের নির্বাচনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এবং বিজয়ীরা আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির আইনজীবী-শিক্ষক নন, হঠাৎ করে হয়ে যাওয়া ব্যবসায়ী এবং অবসরপ্রাপ্ত বেসামরিক-সামরিক আমলা। তারা সবাই গোষ্ঠীতন্ত্র বা অলিগার্কির সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ভিত্তি বা পাওয়ার বেজের পরিবর্তন ঘটেছে ব্যাপকভাবে।
আমাদের আলোচনার বিষয় হলো, বারবার বিপ্লব বা বিপ্লবের অসীম সম্ভাবনাকে সুকৌশলে ‘হত্যা’ করা হয়।
১৯৭১-এর বিপ্লবটি ব্যর্থ করা হয়েছে যখন ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুধু আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধ করেছে—এমন এক বয়ান হাজির করা হয়। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তখনো অস্ত্র। এ সময়েই ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আনন্দ উল্লাস তখনো কাটেনি।
এমনও কথা উঠেছিল যে, সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠিত হবে। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী নীতিনির্ধারণ ও কৌশল কী হবে, সে বিষয়ে সর্বদলীয় কোনো বৈঠকও হয়নি। এমনকি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মতামতও নেওয়া হয়নি—কেমন বাংলাদেশ তারা চান? তাদের কোনো সভা বা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়নি—না কেন্দ্রীয়ভাবে অথবা স্থানীয় পর্যায়ে। যে যার মতো গতিহীন, দিশাহীন, উদ্দেশ্যবিহীনভাবে চলতে শুরু করলেন। আর ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনো নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে অর্থাৎ, বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
দেশে ফেরার দুদিন পর, ১৯৭২-এর ১২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয় এবং এতে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ মুজিবুর রহমান। আর যাই হোক, আওয়ামী লীগ বিপ্লব হোক বা এমন পরিস্থিতি কখনোই চায়নি, দলটির শ্রেণি চরিত্রের কারণে। বরং বিপ্লব সম্পর্কে তাদের ভীত ছিল, যার ভিত্তিতে ১৯৫৭ সালেই আওয়ামী লীগে বিভক্তি দেখা দেয়।
বামপন্থি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো আন্দোলন বা প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারেনি পরিস্থিতিকে বিপ্লবে রূপান্তরের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সব বাম নেতা ঢাকায় এসেও পৌঁছাননি তখন পর্যন্ত। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে বামপন্থি দলভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিপ্লবের কোনো দিকনির্দেশনা বা লিখিত অথবা অলিখিত ‘সুস্পষ্ট নীতি-পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করেননি। ব্যর্থতা এখানেই যে, ৭২ সালেও পারেনি। ভারতে তখন চার মজুমদারের নেতৃত্বে নকশালবাড়ী আন্দোলন চলছিল, যা নিয়ে ভারতের ইন্দিরা সরকার বেশ দুশ্চিন্তায় ছিল। আওয়ামী লীগও চায়নি বামপন্থিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক। মুক্তিযুদ্ধকালেও বামপন্থিরা একদিকে ভারতের নজরদারি এবং আওয়ামী লীগের বিরোধিতার মুখে পড়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তখন বামপন্থিরা বা বিপ্লবী সংগঠনগুলো প্রবল বৈরী সময় পার করছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথমার্ধে ফরাসি প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম লা মদে (La Monde) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “Is the west Pakistan Government not aware that I am the only one able to save east Pakistan from Communism. If they take a Position to fight I shall be pushed out of power and ‘Naxlities’ will enterven in my name” (পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার কি অবগত নয় যে, আমিই শুধু পারি কমিউনিজম থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করতে। তারা যদি কোনো অবস্থান নিতে পারে, তাহলে আমি ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ব এবং ‘নকশালীরা’ তখন আমার নাম ব্যবহার করে ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করবে।)
১৯৭১ সালেই বিপ্লবের সব সম্ভাবনা বিনষ্ট হতে শুরু করে। সংবিধান কার্যকরী হয় ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর। আর এতে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার দায়িত্ব সরকার নেবে বলে যে অঙ্গীকার আওয়ামী লীগ ম্যানিফেস্টোতে করেছিল, তা স্থান পায়নি। এ ছাড়া সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭০ অর্থাৎ ‘রাজনৈতিক দল হইতে পদত্যাগ বা ভোটদান করিলে আসন শূন্য হইবে’ এমন বিধান রাখা হয়। সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী যা ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বরে পাস হয়, যাতে ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণা’র অনুচ্ছেদটি ১৪১(ক)-তে যুক্ত করা হয়। জরুরি অবস্থাকালে মৌলিক অধিকার রহিত করা হয়। এই সংশোধনীতে বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ জারি করার পথ উন্মুক্ত করা হয় এবং সংবিধানে ২৬(৩) ধারা যুক্ত করে জানানো হয়, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ১৪২-এর অধিকারবলে যদি কোনো সংশোধনী আনা হয়, তবে তা মৌলিক অধিকার পরিপন্থি হলেও বাতিলযোগ্য হবে না। এভাবে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সব দল বাতিল করে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ ব্যবস্থা চালু হয়। চারটি পত্রিকা বাদে সব সংবাদপত্র বাতিল করা হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্তদের একদল অর্থাৎ, বাকশাল বা জাতীয় দলে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। এ সংশোধনীতে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সাংবিধানিকভাবে উল্লেখ করা হয়।’ [সূত্রগুলো ‘বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা, গণতান্ত্রিক আইন ও সংবিধান আন্দোলন’ শীর্ষক বুকলেট-প্রকাশ-ডিসেম্বর ২০১৩]
গঠিত হয় রক্ষী বাহিনী। এর দায়িত্ব ছিল বিপ্লবীদের নিধন এবং একটি পার্শ্ববর্তী বিদেশি বিশেষ শক্তির স্বার্থ রক্ষা করা।
এভাবেই হত্যা করা হয় সম্ভাব্য এক বিপ্লবকে। যে মুক্তিযুদ্ধটি হয়েছিল তার মূল উদ্দেশ্য ছিল—‘পুরোনো রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো ভেঙে নয়া বন্দোবস্তের বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক, সাম্য ও ন্যায্যতার এক নতুন দেশ প্রতিষ্ঠা।’ যা হতে পারত, তা হয়নি, বিপ্লব ব্যর্থ হলো, ‘নিহত’ হলো কাঙ্ক্ষিত বিপ্লবের—যার অপূরণীয় ক্ষতি এখনো আমরা বহন করছি।
ইতিহাস পর্যালোচনায় আরেকটি ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা জরুরি। ১৯৭৫ সালের সিপাহি-জনতার বিপ্লব। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত হয় ওই ঘটনাটি। এটিকে প্রকৃতার্থে বিপ্লব বলা যুক্তিসংগত হবে না, কারণ এটি সমাজ ও রাষ্ট্র বদলের লক্ষ্য নিয়ে সংঘটিত হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয় দেশে—বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই তীব্রতর হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল খালেদ মোশাররফ একটি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। জনমনে এবং সেনাসদস্যদের মনে বদ্ধমূল ধারণাটি জন্ম নেয় যে, ভারতের সমর্থনে খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেছেন। এরই প্রতিবাদে ৭ নভেম্বরে সংঘটিত হয় ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’। এ বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ওই ঘটনায় কর্নেল (অব.) আবু তাহের এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের অংশগ্রহণ ছিল। মানুষ ভারতের হাত থেকে ‘নিজেদের’ দেশকে রক্ষার এ ঘটনাটি এভাবে চিহ্নিত করে এবং উল্লাসে রাস্তায় নেমে আসে। এ ঘটনা দেশকে স্থিতিশীল করেছে ঠিকই; কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো বদলের বিপ্লবের ঘটনা এটি নয়, এটি সেনা ও জনতার যৌথ অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করা বাঞ্ছনীয়। বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাই এ ঘটনার মৌল বৈশিষ্ট্য।
বারবার বাংলাদেশে সামরিক শাসনের একপর্যায়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। এটা হঠাৎ কোনো সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের সময়ে বিএনপির মধ্যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে ক্ষমতা আগে থেকেই সামরিক বাহিনীর হাতে চলে গিয়েছিল। যদিও বিচারপতি সাত্তার পরবর্তীকালে বলেছেন, ‘কোনো কারণ ছাড়া গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা (সেনাবাহিনী) ক্ষমতা হরণ করেছে।’ (দৈনিক সংবাদ, ১১ অক্টোবর-১৯৮৪)। এরশাদের শাসন কোনোক্রমেই সুখকর ছিল না। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে তীব্র ছাত্র-আন্দোলন শুরু হয়। পাশাপাশি ১. বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট; ২. আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট; ৩. বাম দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বামজোট অর্থাৎ তিন জোটের তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। এরশাদ ‘বৈধতার সংকটে’ ভুগেছেন আগাগোড়া। ১৯৮২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনে অর্থাৎ, ’৮২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনে কমপক্ষে ২৫০ জন নিহত হন। হরতাল হয়েছে পৌনে চার হাজার ঘণ্টা। ১৯৮৮ সালে হরতাল হয়েছে ৬৭ দিন এবং ১৯৮৯ সালে ২৩৯ দিন। [আমীর খসরু, সংকটে গণতন্ত্র: সামরিক শাসনোত্তর বেসামরিক শাসনের সমস্যা, অনন্যা প্রকাশনী ২০২৩; পৃ-১৫৭] (চলবে)
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
মন্তব্য করুন