জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট নিরসনের দুয়ার কি বন্ধ হয়ে গেল? সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে বিপরীত অবস্থানের কারণে দেশে কি দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তাঘেরা রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হতে যাচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বৈঠকের ফল এবং দ্রুতই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আলোচনা সামনে আসায় অনিশ্চয়তা শব্দটি বিশ্লেষকদের কাছে গুরুত্ব আছে। দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে ১০ নভেম্বর পঞ্চম প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ‘টু প্লাস টু বৈঠক’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের নিজ নিজ অগ্রাধিকার ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশল এবং সহযোগিতা ছাড়াও বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
দিল্লি ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দিয়েছে, ‘নির্বাচন বা উন্নয়ন একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এতে ভারত কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমান মার্কিন নীতি এ অঞ্চলে চীনের আধিপত্য বাড়াবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দেবে।’
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরেছে। মোটকথা, যুক্তরাষ্ট্র চীনের আধিপত্য ঠেকিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্ব চায়। অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থরক্ষায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব ও বলয় বিস্তার করার লক্ষ্য ভারতের।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে শর্তহীনভাবে সংলাপের জন্য চিঠি দিয়েছেন। এটাই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট নিরসনের শেষ পদক্ষেপ হতে পারে। চিঠিতে মূলত তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন দেখতে চায়। দ্বিতীয়ত, শর্তহীনভাবে সংলাপের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা নীতি গ্রহণ করেছে, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো দল থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
আজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার কথা রয়েছে।
এদিকে শেষ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনে আসবে বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে বিএনপি ও তার মিত্ররা বলেছে, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া তারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংগ্রহণ করবে না। নির্বাচনের সম্ভাব্য তপশিল ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে বিরোধী দলগুলো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে মরণপণ আন্দোলনে নামবে। দরকার হলে তারা আরও কঠোরতার সঙ্গে নির্বাচনের পরিকল্পনা বাতিল করাতে সরকারকে বাধ্য করবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা সংবিধানের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো পদ্ধতির নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়। অন্যদিকে বিএনপি ও তার আন্দোলন সঙ্গীরা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচনে যাবে না।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ মনে করে, জনগণ অর্থাৎ ভোটাররা অংশগ্রহণ করলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বলে, যে নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে, যে রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক ভোটার রয়েছে ও তাদের মধ্য থেকে যদি কোনো রাজনৈতিক দলের জয়ের সম্ভাবনা থাকে এবং সেই দলগুলো যদি স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, তাহলেই তাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে।
গণতন্ত্রহীন রাজনৈতিক দলের শাসনব্যবস্থা একজন বা একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত, যাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। এরকম বাংলাদেশে, বড় কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে যেহেতু গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, তাই প্রতিটি দল ব্যক্তিনির্ভর। এই ব্যক্তিনির্ভর বা কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারে না। তাদের মধ্যে নির্বাচনকে মাধ্যম করে ক্ষমতায় যাওয়ার ‘প্রবণতাই’ প্রধান। এ ধরনের শাসনব্যবস্থার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হলো রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করা। এ ব্যবস্থায় সরকারি দল এবং বিরোধী দল একে অন্যকে নির্মূল করতে চায়।
এদিকে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপানসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, সহিংসতামুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়। সেইসঙ্গে দেশগুলো মনে করে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করে। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার প্রশ্নে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিরোধকে ঘিরে দেশব্যাপী রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন অভিযানের পটভূমিতে এবারের ইউপিআরের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এদিকে সরকারবিরোধী বলয়ের দাবি, সরকার সব রাজনৈতিক দলের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি না করে ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতোই একপক্ষীয় একটি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো পঞ্চম দফায় সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো গত ২৯ অক্টোবর থেকে বিরতি দিয়ে দিয়ে হরতাল-অবরোধ ডাকছে। এই চলমান অবরোধে এ পর্যন্ত দেশজুড়ে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, প্রায় ১১৫ যানবাহনে আগুন ও প্রাণ দিয়েছে কমবেশি ১১ জন। অবশ্য জানমালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় পাহারায় আছেন সরকারি দলের নেতাকর্মীরা।
বর্তমান রাজনীতিকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা, হরতাল-অবরোধ এবং সম্ভাব্য বিদেশিদের কঠোর চাপ যদি আরও ঘনীভূত বা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সব মিলিয়ে দেশের এই ভঙ্গুর অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা’ আছে, যা মার্কিন জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয়ত, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে ভূরাজনীতি। প্রধানত, এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি জনগণ-সমর্থিত গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা কার্যকর রাখতে চায়, যাতে বাংলাদেশ চীনের বলয়ে ঢুকে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা স্থায়ী করতে না পারে বা একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে না পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে বাংলাদেশে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। দেশটি বলেছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য যা প্রয়োজন তাই করবে। এমতাবস্থায়, রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতার মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে বহির্বিশ্বের সম্ভাব্য সব ধরনের হস্তক্ষেপ বা কঠোর ব্যবস্থা এড়াতে পারে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক