বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল দেখতে সুদর্শন, কথাও বলেন চমৎকার। শুদ্ধ উচ্চারণে তার কথা শুনতে ভালো লাগে। তবে সমস্যা একটাই, কথা একটু বেশি বলেন তিনি। ব্যাপারটি হয়তো তিনি বুঝেছেন। তাই ইদানীং কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। এখন নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্র সচিব জাহাংগীর আলম। সংবিধানে থাকলেও বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো আইন ছিল না। বর্তমান সরকার আইন প্রণয়নের পর কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনই সে আইনের আওতায় গঠিত প্রথম কমিশন। আইনের আওতায় গঠিত হলেও বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করতে পারেনি এ কমিশন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের যে অনাস্থা, নির্বাচন কমিশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে অনাস্থার শিকার হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও কাজী হাবিবুল আউয়াল বিএনপিসহ বিরোধী দলকে কমিশনে আনতে পারেননি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কমিশনের চেষ্টায় আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি দেখিনি। কাজেও তিনি আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সে চেষ্টা সবসময় ধরে রাখতে পারেননি। গাইবান্ধা উপনির্বাচন বাতিল করলেও সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুর উপনির্বাচনের ফলাফল ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি। নির্বাচন কমিশনের চেষ্টায় আন্তরিকতার পাশাপাশি অসহায়ত্বও ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, চাইলেও অনেক কিছু করার উপায় নেই তার।
রাজনীতির মাঠে কোনো সমঝোতা ছাড়াই গত বুধবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছেন। সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। কিন্তু তাদের পক্ষে এসব শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়, এটা তাদের এখতিয়ারও নয়। নির্বাচন কমিশন চাইলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারে। তাদের যে সাংবিধানিক দায়িত্ব ও ক্ষমতা, তাতে এ চারটি শর্ত পূরণ তারা করতেই পারে। এজন্য দরকার শুধু আন্তরিকতা ও দৃঢ়তা। কিন্তু অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হওয়ার পরও সেটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়, এটা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। যত শর্তই পূরণ হোক, এমনকি অংশগ্রহণমূলক হলেও তা যে গ্রহণযোগ্য হবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। পরাজয় মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। নির্বাচন যত ভালোই হোক, পরাজিত দলের কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ বা ২০০৮ সালের নির্বাচন সাধারণভাবে নাগরিক সমাজ গ্রহণ করলেও পরাজিত দল আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কাছে তা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই এটা আগে থেকেই মেনে নেওয়া ভালো, ফেরেশতারা এসে নির্বাচন করলেও বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তবে একটি ভালো নির্বাচনের প্রাথমিক শর্ত সেটি অংশগ্রহণমূলক হওয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন অসহায়। যেমন এই মুহূর্তে বিএনপির নির্বাচনে আসা না আসাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর বিএনপি আছে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে। নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টি তাদের কোনো এজেন্ডাতেই নেই। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কী করতে পারে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তো আসলে রেফারির। তারা সমতল মাঠ তৈরি করে অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু কোনো দল যদি মাঠে না আসে, রেফারি তো তাদের জোর করে মাঠে আনতে পারবেন না।
বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার পাশাপাশি কিছু কথাও বলেছেন। তার কণ্ঠে আসলে আমি দৃঢ়তার চেয়ে অসহায়ত্ব বেশি পেয়েছি। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’ প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ভুলে যাননি তিনি, ‘নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষত নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে, দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে। কিন্তু মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আস্থা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় নিয়ামক।’ এরপর তিনি বলেছেন আসল কথাটি, ‘আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে সদয় হয়ে সমাধান অন্বেষণ করতে। পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।’
অনেকেই মনে করছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নির্বাচনী তপশিল ঘোষণা করা ঠিক হয়নি। কমিশন চাইলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারত। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো প্রক্রিয়া চলমান থাকলে নির্বাচন কমিশন অপেক্ষা করতেই পারত। কিন্তু রাজনীতির মাঠে এখনো দুপক্ষ অনড় অবস্থানে রয়েছে। তাই অপেক্ষা করা না করা নির্বাচন কমিশনের জন্য অর্থহীন। তাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা শেষ হয়ে গেছে। এখন বল একদমই রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে। তপশিল ঘোষণার ঠিক আগে আগে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়ে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাতে চিঠিটি পৌঁছে দিয়েছেন। এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ওবায়দুল কাদের জানিয়ে দিয়েছেন, এখন আর সংলাপের কোনো সুযোগ নেই।
দুপুরে ওবায়দুল কাদের জানিয়ে দিলেন, সংলাপের আর কোনো সুযোগ নেই। সন্ধ্যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার তপশিল ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচনী ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে দিলেন। এখন এই ট্রেন কি বিএনপিকে ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে? মনে হতে পারে, তপশিল ঘোষণার পর সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কার্যত সমঝোতার সুযোগ এখনো রয়ে গেছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। তার মানে আরও ১৪ দিন সময় বাকি আছে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে তপশিল পেছানোও অসম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের তাগিদে যদি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি শর্তহীন সংলাপে সম্মত হয়; যদি আলোচনার টেবিলে উপায় বেরিয়ে আসে, তাহলে সমাধান অসম্ভব নয়। জটটা দীর্ঘদিনের, তবে চাইলে এক বসাতেই খুলে ফেলা সম্ভব। তবে নিশ্চিত করতে সবপক্ষের মধ্যেই যেন ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকে।
আমি আশাবাদী মানুষ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, ‘পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।’ এ সাধ্য কাজটাই যেন রাজনীতিবিদরা করেন। নইলে গভীর সংকটে পড়তে পারে দেশ।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ