তুষার কান্তি সরকার
প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:১৭ এএম
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:২৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দূষণের অসুখে ভুগছে ঢাকা

দূষণের অসুখে ভুগছে ঢাকা

বিশুদ্ধ বাতাস মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান, নির্মল পরিবেশের প্রতীক। কিন্তু সেই বাতাস যখন বিষাক্ত হয়ে ওঠে তখন বিপন্ন হয় পরিবেশ; বিপর্যস্ত হয় জনজীবন। বায়ুর গুণমান পৃথিবীর জলবায়ু এবং বিশ্বব্যাপী বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। মানুষের কর্মকাণ্ড ও প্রাকৃতিক কারণেই সাধারণত বায়ুদূষণ হয়। বায়ুদূষণের কারণে মানুষ বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়।

‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’ সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাস করছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

বাংলাদেশে যত মানুষ অকালে মারা যায়, তাদের ২০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ বলে উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায়। ‘বিশুদ্ধ বায়ু পাওয়ার চেষ্টা : দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টি শহরের ৯টিই হলো দক্ষিণ এশিয়ায়, তার মধ্যে ঢাকা অন্যতম।

বায়ুদূষণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। চিকিৎসকরা জানান, বায়ুদূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, প্রজনন ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়।

সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই)-এর স্কোরে বায়ুদূষণের শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে ঢাকার নাম, যা স্বাস্থ্যের জন্য ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচিত। বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকা কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয়, কখনো তৃতীয় স্থানে থাকছে।

শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় ৫ বছর ৪ মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় ৭ বছর ৭ মাস। দেশের বাতাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক পিএম ২.৫-এর পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা পরিমাণের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি।

শীতকালে বৃষ্টি না হওয়ায় বাতাসে ধুলোবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া রাজধানীর চারপাশের প্রায় ১২ হাজার ইটভাটার কারণে পেনসিলরঙা মেঘে ঢেকে যায় আকাশ। ইটভাটার ধোঁয়া আর শহরের ধুলোবালিতে জনবহুল রাজধানী শিকার হয় দূষণের শোষণে।

২০১৯ সালের মার্চে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো—ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ কর্মকাণ্ডের ধুলোবালি।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, শহরের মাত্রাতিরিক্ত দূষণে মানুষের রোগবালাই বাড়ছে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলগুলো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। গবেষণা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার অন্য যে কোনো দূষণের চেয়ে বেশি হচ্ছে বায়ুদূষণ।

একিউআইয়ের স্কোরে বায়ুমান শূন্য থেকে ৫০ ভালো হিসেবে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ মাঝারি হিসেবে গণ্য করা হয়; আর সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তাকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু বলে মনে করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোরকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর ৩০১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে থাকা একিউআইকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা মানুষের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে, সেগুলো হলো—বস্তুকণা (পিএম ১০ ও পিএম ২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)।

প্রতিদিনের বায়ুমান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে তথ্য দেয়। পাশাপাশি সেই শহরের বাসিন্দাদের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানিয়ে দেয়।

২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকারের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন বিশ্ববিদ্যালয় ও রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যৌথভাবে একটি গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে যে বায়ুদূষণ ঘটছে, তার অন্যতম কারণ আন্তঃসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ। ইরান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তানের শুষ্ক মরু অঞ্চল থেকে ধূলিকণা বাতাসে মিশে যায়। পশ্চিমা লঘুচাপের মাধ্যমে ওই ধূলিকণাসহ বাতাস ভারতে প্রবেশ করে। নভেম্বর থেকে ওই দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে।’ প্রতিবেদনটিতে পরিষ্কারভাবে আরও বলা হয়, ‘ভারতের কলকাতা, মুম্বাই, পাকিস্তানের করাচি ও বাংলাদেশের ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে মারাত্মক যানজট ও ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সেখানে প্রচুর পরিমাণে ধুলোবালিও বাতাসে মিশছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ওই শহরগুলো এ অঞ্চলের বায়ুকে দূষিত করে ফেলছে।’

দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বব্যাংকের রিজিওনাল ইন্টিগ্রেশন বিভাগের পরিচালক সেসিল ফরুম্যান বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একই এয়ারশেডে অবস্থিত। এসব অঞ্চলের বায়ুর মানও একই। তাই দেশগুলো সমন্বিত ব্যবস্থা নিয়ে বায়ুদূষণের উদ্বেগজনক মাত্রা কমাতে পারে। একসঙ্গে কাজ করলে দ্রুত ও কম খরচে কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে।’

যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া, বিভিন্ন বস্তির প্রায় ৪০ লাখ চুলায় আবর্জনা, কেরোসিন ও কাঠ-কয়লা দিয়ে রান্নার ধোঁয়া, ঢাকার আশপাশে ইটভাটার ধোঁয়া, নির্মাণসামগ্রী না ঢেকে কাজ করা, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার বাস-ট্রাক ও যানবাহনের ধুলা ও ধোঁয়া এবং রাস্তা ও চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের ধুলা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। এগুলোর পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণের জন্যও দেশের বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।

বায়ুদূষণ রোধে দূষিত শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা, নির্মাণকাজের সময় নির্মাণ স্থান ঢেকে রাখা, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেওয়া, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা, যানজট কমানো, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া গাছ লাগানো, ছাদবাগানে উৎসাহিত করার পাশাপাশি জলাধার সংরক্ষণে বায়ুদূষণ রোধে সুফল পাওয়া যেতে পারে।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, নিসর্গবার্তা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গণভোট মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জামায়াতের

গাজার ফুটবল পুনর্গঠনে সহায়তার অঙ্গীকার ফিফা সভাপতির

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে আবার রেকর্ড

কুমিল্লা বিভাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মিছিল ও সমাবেশ

চাকসু নির্বাচন / ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থীকে সমর্থনে সরে দাঁড়ালেন এক প্রার্থী

মিরপুরে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার শোক

বিয়েতে বন্ধু না আসায় কবুল বলেনি বর

চাটুকারিতাকে যেভাবে পররাষ্ট্রনীতিতে রূপ দিলেন শেহবাজ শরিফ

ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য শরিয়াভিত্তিক হাউস-কার লোন চালুর পরামর্শ আহমাদুল্লাহর

আগামীর নেতৃত্বে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার আহ্বান ধর্ম উপদেষ্টার

১০

জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ১৩ কর্মকর্তার-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা

১১

৪৯তম বিশেষ বিসিএসে অংশ নেননি ৪১ শতাংশ পরীক্ষার্থী 

১২

মাদাগাস্কারের ক্ষমতা দখল করল সেনাবাহিনী

১৩

কালবেলার সাংবাদিকের বাবার মৃত্যুতে দোয়া মাহফিল

১৪

জুলাই আন্দোলনে সামনের কাতারে ছিল তা’মীরুল মিল্লাতের ছাত্ররা : ভিপি সাদিক

১৫

রাকিবের গোলে হংকংয়ের মাঠে বাংলাদেশের ড্র

১৬

মালয়েশিয়ায় ভূমিধসে বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যু

১৭

হজযাত্রী নিবন্ধনের সময় বাড়ল

১৮

সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে মিয়ানমার নাগরিক নিহত

১৯

গাজা শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করল যুক্তরাষ্ট্র-মিসর-কাতার-তুরস্ক

২০
X