নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী দখলের মচ্ছবের ইতিহাস আজকের নয়। সুদীর্ঘ সময় ধরে চলছে এই মহোৎসব। ফলে অধিকাংশ নদীর নাম কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে দৃশ্যমান নয়। এসব নদী মরে যাওয়া বা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যান্য কারণ থাকলেও দখল একটি বড় কারণ। সোমবার কালবেলায় প্রকাশিত ‘ছয় প্রতিষ্ঠান গিলছে তুরাগ’ শীর্ষক প্রধান শিরোনামে দখলদারির এ মচ্ছবের চিত্রকেই তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর দিয়াবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে আশুলিয়া বেড়িবাঁধ পর্যন্ত দেশের ছয়টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান—মাইশা কনস্ট্রাকশন, করিম গ্রুপ, দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এসইএল), পথ বিল্ডার্স, ক্রাউন সিমেন্ট-এর রেডিমিক্স কারখানাসহ ছোট-বড় আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের রেডিমিক্স কারখানার সঙ্গে বিপুলসংখ্যক ইটভাটা কীভাবে গিলে খাচ্ছে তুরাগ নদকে। সবকটি কারখানাই গড়ে তোলা হয়েছে তুরাগ নদের জায়গা দখল করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান পুরোটাই নদের একেবারে ভেতরে। কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের মালপত্র লোড-আনলোডের সময় বর্জ্য পড়ছে নদে। নিয়মিত বালু ফেলে ভরাট করে ধীরে ধীরে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে এসব কারখানা। এর ফলে কমে যাচ্ছে নদের প্রস্থ। ঢাকা নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা চারটি নদীর অন্যতম এ তুরাগ নদের দৈর্ঘ্য ৬২ কিলোমিটার, গভীরতা ১৩.৫ মিটার। প্রস্থ ৮২ মিটার হলেও বাস্তবে কোথাও কোথাও তা ২০-২৫ মিটারে নেমে এসেছে। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এর পুরোভাগেই রয়েছে দখলদারির চিত্র।
প্রতিবেদন অনুসারে, বেড়িবাঁধ ধরে হেঁটে চললে চোখে পড়ার কথা নদের নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিন্তু এখন সারি সারি শিল্পকারখানা ছাড়া চোখে পড়ে না কিছুই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নদ দখল করে, কোথাও আবার আংশিক দখল করে গড়ে উঠেছে এসব প্রতিষ্ঠান। বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে দেদার। প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই মেতেছে দখল উৎসবে। ফলে রং হারিয়েছে নদ। অথচ একসময় প্রমত্তা এ তুরাগের জীবন-যৌবন সবই ছিল। তখন এ নদ প্রাকৃতিকভাবে জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ বহু মানুষের জীবিকা নির্বাহের উপজীব্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সুদীর্ঘ সময় ধরে নিঃস্বার্থভাবে এ নদ আমাদের রক্ষা করেছে নানাভাবে। এখন তুরাগের পানিতে হাত দিতেও ভয় পান মানুষ। দুর্গন্ধে নাক বন্ধ রাখতে হয়। স্থানীয়দের ভাষ্যে, ‘চোখের সামনে নদডারে খাইয়া ফেলল!’
আমরা জানি নদীর চিত্র সারা দেশে একই। রাজধানী পাশ দিয়ে শতবর্ষ ধরে বয়ে চলা প্রমত্তা বুড়িগঙ্গার দৈন্যদশার কথাও আমরা জানি। এ নদীও দূষণ, দখলের খপ্পরে আজ মৃতপ্রায়। মাঝেমধ্যেই দখলদারদের বিরুদ্ধে নানা অভিযান চালানো হয়। কিছুদিন পর আবার আগে যা ছিল, সে চিত্রই ফিরে আসে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষসহ নদী রক্ষার জন্য রয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নামে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। স্বভাবতই এ প্রশ্ন জোরালোভাবে ওঠে যে, তাদের কাজ আসলে কী? এসবের দায় কি তারা এড়াতে পারেন? সারা দেশ তো রয়েছেই, রাজধানী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলজ্যান্ত এই নদটিও দীর্ঘদিন ধরে মনুষ্য দখল আর দূষণের কবলে পড়ে মৃতপ্রায়, অথচ তাকে রক্ষার কেউ নেই!
যেসব প্রতিষ্ঠান তুরাগের দূষণ ঘটাচ্ছে ও দখল করে ধ্বংস করছে, তারা কিন্তু রাতের অন্ধকারে করছে না। দিনের আলোয় দিনের পর দিন করে যাচ্ছে এসব কাজ। কারা করছে তা অতি স্পষ্ট, তাহলে কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? তুরাগে দখলদারির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টরা এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন—এটাই প্রত্যাশা।