এম জাকির হোসেন খান
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:১৯ এএম
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৫১ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ সাক্ষাৎকারে এম জাকির হোসেন খান

প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো আবশ্যক

এম জাকির হোসেন খান। ছবি: কালবেলা
এম জাকির হোসেন খান। ছবি: কালবেলা

এম জাকির হোসেন খান আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী। সদ্য শেষ হওয়া কপ-২৮ সম্মেলন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও তা মোকাবিলায় করণীয়সহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

কালবেলা: বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮) শেষ হয়েছে। কেমন হলো এবারের সম্মেলন?

এম জাকির হোসেন খান: ২৮তম আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন শেষ হয়েছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের প্রধান টার্গেটগুলো অর্জনের জন্য আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে এবারের সম্মেলন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান টার্গেট হলো, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নামিয়ে রাখা। সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের যুগ থেকে গ্লোবাল বয়েলিংয়ের যুগে প্রবেশ করেছি। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হবে কি না, সেটা প্রশ্নের সম্মুখীন।

১৮৬০ সালের পর গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে প্রথম বিশ্বে এত বেশি তাপমাত্রা দেখা গেছে। সুতরাং প্যারিস চুক্তির আলোকে প্রতিটি স্বাক্ষরকারী দেশ ও প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী কোম্পানিদের কার্যকর অবদান নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতা পদ্ধতি থাকা দরকার। যার মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, তারা কে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ এবং তা কী অনুপাতে ২০৩০ সাল নাগাদ কমাবে; ক্ষতিপূরণ হিসেবে জলবায়ু তহবিল কী পরিমাণে প্রদান করবে, সেটা ২০২৪ সালের মধ্যে নির্দিষ্ট করা দরকার। শুধু প্রতিশ্রুতি দিলে হবে না, বরং জলবায়ু তহবিল হিসেবে ক্ষতিপূরণের প্রয়োজনীয় অনুদানভিত্তিক অর্থ কখন প্রদান করা হবে এবং একই সঙ্গে সেই অর্থ কীভাবে, কোথায় কতটুকু ব্যয় করা হবে, সেটা নির্ধারণ করাও জরুরি। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পুরো পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ কতটুকু কখন কমাবে সেটা স্পষ্ট করার পাশাপাশি কীভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে।

দ্বিতীয়ত গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন গোল নির্ধারণ করতে হবে। এটা এমন হওয়া উচিত যাতে পুরো বিশ্বের মানুষের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে। প্যারিস চুক্তিতে বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশের অভিযোজন হতে হবে সেই দেশের চাহিদা অনুযায়ী এবং সেটা স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, প্রকৃতি ও প্রতিবেশের সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষের অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। নৃতাত্ত্বিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই অভিযোজন বা এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসব কার্যক্রমে স্থানীয় ইকোসিস্টেমকে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রশ্ন হলো, বাস্তবে কোন দেশ কতখানি তা নিশ্চিত করছে, কিংবা যথাযথ ঝুঁকি যাচাই করে কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত না করলে দুর্বল বা খারাপ অভিযোজনের কারণে অর্থের অপচয় হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি দেশ প্রয়োজনীয় অভিযোজন তহবিলের দাবিদার। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করেছে, এটা বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের প্রতিবছর কমপক্ষে ৮.৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। যে দেশগুলো অভিযোজন করছে সেই অভিযোজনের জন্য যেরকম তহবিল প্রয়োজন, বাস্তবে তার মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ পাচ্ছে, তাও অধিকাংশ ঋণ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিবছর যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে, সেটা রিকভার করতে বছরে কমপক্ষে ১৫০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। সেখানে জলবায়ু চুক্তির অ্যাডাপটেশন ফান্ডে রয়েছে মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার। সামনে যত দুর্যোগ বাড়বে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তত বাড়বে। একটা পর্যায়ে অভিযোজন তহবিলের চাহিদা প্রগতিশীল হারে বাড়বে। সুতরাং বৈশ্বিক অভিযোজনের লক্ষ্যমাত্রা বিশেষ করে প্রতিটি পরিবার বা কমিউনিটিতে টেকসই অভিযোজন কতটুকু অর্জিত হলো এবং তা ২০৩০-এর মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা, সেটা কপ-২৯-এ সুনির্দিষ্টভাবে আসা উচিত। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান করতে হবে। জি২০-ভুক্ত দেশগুলো যদি জীবাশ্ম জ্বালানিবাবদ প্রদত্ত ভর্তুকির মাত্র ১০ শতাংশ কমালে প্রায় বছরে ১৩০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন জলবায়ু অভিযোজন বা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ব্যয় করা যায়। একই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণ কমবে এবং জলবায়ু তহবিলের ঘাটতি পূরণ হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু ফান্ড ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেশগুলোর জন্য যে অর্থ ধার্য করা হয় তা দেশভিত্তিক না হয়ে ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কার্বন নিঃসরণের হারের ভিত্তিতে ধার্য করা উচিত। শিল্পোন্নত দেশের নেতাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়, যুদ্ধ অর্থায়নের ন্যায় অগ্রাধিকার প্রদান করলেই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা পেতে পারে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কোন দেশ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত সেই অনুযায়ী অর্থ বিতরণ করতে হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অ্যাডাপটেশনের অর্থ অনুদানভিত্তিক না দিয়ে ঋণ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা এটা চাই না। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে এরই মধ্যে ঋণভারে জর্জরিত, সেটা মাফ করে দিয়ে অনুদান হিসেবে জলবায়ু অর্থায়ন না করলে অদূর ভবিষ্যতে ক্রয়ক্ষমতা কমে বৈশ্বিকভাবে মন্দা ব্যাপক আকারে দেখা দিতে পারে।

কালবেলা: বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে এবারের জলবায়ু সম্মেলনে তেমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি?

এম জাকির হোসেন খান: বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমাতেই হবে। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্রা এখন বিপজ্জনক মাত্রার থেকেও দ্বিগুণ বেশি। এরই মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ তা বৃদ্ধি পেয়ে ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছলে যেমনটা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন, তার ফলে পৃথিবী অবধারিতভাবে ধ্বংস হতে বাধ্য। বর্তমানে যেভাবে ভোগ করছে পৃথিবীর মানুষ তাতে এরকম তিনটি পৃথিবী দরকার, যেটা আদতেই অসম্ভব। সুতরাং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, আগামী সাত বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতেই হবে। যদি কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে এটা সম্ভব নয়।

ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মানুষ এবং প্রকৃতির সুরক্ষা প্রদানে সামনে শুধু একটাই রাস্তা খোলা। হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের দায়ী দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে অথবা আমাদের নিজেদের বাঁচার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীতে যে ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ছে, সেটা কমাতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ প্রদানে শিল্পোন্নত দেশগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে, উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশগুলোর উচিত ধনী দেশগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ওপর সম্মিলিতভাবে দূষণ করারোপ করা।

কালবেলা: আমাদের বিদ্যুৎ দরকার এবং তার জন্য আমরা না চাইলেও কয়লা, গ্যাস বা জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে বাধ্য হই। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কী করণীয়?

এম জাকির হোসেন: কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে কী যে বিশ খাওয়া ভূল ছিলো, এটা কোনো যুক্তিবাদী দেশগুলোর অবস্থান হতে পারেনা। আমরা সকলেই জানি যে শিল্পবিপ্লবের কারণেই সারা পৃথিবী উত্তপ্ত হয়েছে, যার ফলে উন্নয়নের মডেল ভূল ছিলো এবং সে কারণেই টেকসি উন্নয়ন সামনে এসেছে। উন্নয়নের এই রাস্তাটি সঠিক ছিল না। সেই ভুল রাস্তাটি অবলম্বন করে কেনসামনে এগোতে চাইবো, এটা এক ধরনের আত্মহূতি। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের মূল কথা হলো—প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুরক্ষা দিয়ে অবকাঠামোভিত্তিক উন্নয়ন।

বন ধ্বংস, নদী দূষণ ও খাল-বিল দখল চালিয়ে তো এনভায়রনমেন্টাল বা ক্লাইমেট জাস্টিস অর্জন হতে পারে না। স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে দূষণ বা প্রকৃতি ও পরিবেশবিরোধী কার্যক্রমের পেছনে শিল্পোন্নত দেশগুলোরও দায় রয়েছে, যেমন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষ হয়। সেই চিংড়ির প্রধান ভোক্তা ইউরোপের দেশগুলো। চিংড়ি রপ্তানি করে বছরে মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রকৃতি ও পরিবেশের বা কৃষির যে ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ কত হাজার কোটি টাকা সে হিসাব করতে হবে। আমরা এই অর্থনৈতিক অপরচুনিটি কস্টগুলো হিসাব করি না।

আমরা এখন যে জিডিপির ভিত্তিতে উন্নয়নের মাপকাঠি নির্ধারণ করি, এটা টেকসই উন্নয়ন পরিমাপের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সুস্থভাবে বাঁচতে হলে আমাদের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পাথওয়েতে যেতে হবে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যখন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, সেটা সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বা টেকসই জীবিকা অর্জনে তেমন ভূমিকা রাখে না। আমরা যদি নিজেরাই পরিবেশ প্রকৃতি সুরক্ষার শর্তগুলো না মানি তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবেশ ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়ার যৌক্তিকতা হারাবে। আমরা যে তহবিল পাই সেটা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার না করি বা দুর্নীতি হয় তাহলে সেটা খারাপ অভিযোজনের উদাহরণ হবে, যা বেড়ে গেলে জলবায়ু দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি বাবদ প্রস্তাবিত অর্থ পাওয়ার যৌক্তিক অবস্থান হারায়।

কালবেলা: জলবায়ু দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে, ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় আন্তর্জাতিক অনুদানভিত্তিক তহবিলের বরাদ্দ অনেক কম, এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কী করণীয়?

এম জাকির হোসেন খান: আগে যখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ছিল না, স্যাটেলাইট ইমেজ ছিল না তখন যতটা সহজে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স পাওয়া যেত এখন দিনে দিনে সেটা আরও জটিল প্রক্রিয়ায় ঢুকছে। এখন আমাদেরকে আগে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা সত্যিকারার্থে ভুক্তভোগী, দেশের পরিবেশ প্রকৃতির বিপর্যয়ে আমাদের নিজেদের কোন অবদান নেই, বাস্তবে যা কঠিন। যেমন দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ কতটুকু, এটা প্রশমনযোগ্য কিনা, কতটুকু প্রাকৃতিক কারণে হয়েছে আর কতটুকু চিংড়ি ঘেরের কারণে নিজেদের সৃষ্টি সেটা প্রমাণ করতে হবে, আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ পাওয়ার এখতিয়ার বলবৎ রাখতে হলে।

বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষকে সুরক্ষায় সুনির্দিষ্টভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আমি সর্বশেষ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক জলবায়ু সম্মেলনে সাউথ এশিয়ান রেসিলিয়েন্স ফান্ডের (সার্ফ) ফ্রেমওয়ার্ক উপস্থাপন করেছি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষের জন্য আমাদের নিজস্ব তহবিল ব্যবস্থাপনা দাঁড় করাতে হবে। প্রতিনিয়ত আমাদের এ অঞ্চলে দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালে সৃষ্টি হয়েছে আটটি ঘূর্ণিঝড়, অর্থাৎ আমাদের এ অঞ্চল আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক অর্থ সহায়তা কখন আসবে তার জন্য তো আমরা বসে থাকতে পারি না। জলবায়ুতাড়িত মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে অর্থাৎ খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, নিরাপদ পানির জন্য যাতে আমরা তাৎক্ষণিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারি তার জন্য সাউথ এশিয়ান রেসিলিয়েন্স ফান্ড (সার্ফ) দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় সেখানেই এ অর্থ কাজে লাগাতে হবে।

বিভিন্নভাবে এই ফান্ড এর অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। যেমন- কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি, কার্বন ট্যাক্স, যাকাত এর পাশাপাশি আমরা দূষণ কর বসাতে পারি। ব্যাক্তিগত অনুদান সহ নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ থেকে যারা দেশের বাইরে অবস্থান করেন অন্তত এক কোটি মানুষের কাছ থেকে বছরে কমপক্ষে ১০০ ডলারের বন্ড দিয়ে এক বিলিয়ন ডলার জলবায়ু ফান্ড তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেকটা রাষ্ট্র এই ফান্ড গঠন করতে পারে।

আমাদের যথার্থ পাবলিক ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরি করতে হবে। ঢাকায় বসবাসরত একজন ব্যক্তি তার গ্রামের জন্য কোন উদ্যোগে অর্থ সহায়তা করবেন। এরকম অর্থ সহায়তা সব সময় দেখা যায়। এলাকাভিত্তিক বা গ্রাম ভিত্তিক জলবায়ু রেজিলিয়েন্স এর জন্য তারা সহায়তা করতে পারেন। তেমনি দিল্লি বা কাঠমুন্ডু তে যারা বসবাস করেন তারাও সেসব দেশের গ্রামাঞ্চলে জলবায়ু ফান্ডে অর্থ প্রদান করতে পারেন, শুধু দরকার বিশ্বাসযোগ্য পাবিলিক ফাইন্যান্স ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশীপ পদ্ধতিতে বিনিয়োগ এবং সবুজ উদ্যোক্তার মাধ্যমে পরিবেশ দূষন ও জলবায়ু দুর্যোগের টেকসই সমাধান সম্ভব।

বাংলাদেশে যাকাতের পরিমাণ মোট জিডিপির প্রায় তিন-চার শতাংশ। এই অর্থটি এলোমেলোভাবে খরচ হয়। পাবলিক ফান্ড হিসেবে এই অর্থটি আমরা ব্যায় করতে পারিনি। সরাসরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় নয় বরং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে যেখানে যেটা প্রয়োজন সেখানেই এই অর্থটি খরচ করা যেতে পারে। যেকোনো ধরনের দুর্যোগ ঝুঁকিতে বা দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য বা দুর্যোগ বা অন্যান্য খাতে আমরা ভর্তুকি-ভিত্তিক বীমা সেবা চালু করতে পারি। সেই ফান্ডের অর্থ যাকাত থেকেও যেতে পারে। অর্থাৎ এখানে এক হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে লক্ষ টাকার চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যাবস্থা করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এভাবে প্রত্যেকটা মানুষকে আমরা ঝুঁকির বাইরে নিয়ে আসতে পারি। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রয়োজন নিয়ে আলোচনা বেশি হওয়া উচিত, যাতে প্রত্যেকটা দেশ এই ইনোভেশনের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।

কপ-২৮ এ ক্লাইমেট এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ নামে বাংলাদেশে ৮ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড তৈরি করা হবে, মূলতঃ আগেই প্রতিশ্রুত তহবিল প্রধান ভূমিকা রাখবে। কিন্তু তহবিল তৈরি করাটাই বড় বিষয় নয়, এর সঠিক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। ৭ম পঞ্চবার্ষিকীতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন জলবায়ু তহবিল কৌশল প্রণ্যন করা হয়নি, জরুরী ভিত্তিতে এটা প্রণয়ন করা উচিত।

কপ-২৮ এ লস এন্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সের কথা বলা হচ্ছে তা নির্দিষ্টভাবে উন্নয়নশীল দেশের অভিযোজন এবং ক্ষয়-ক্ষতি বাবদ প্রতিবছর নির্ধারিত হারে প্রদান করতে হবে। চাহিদাভিত্তিক নয় বরং দেশ ভিত্তিক যে পরিকল্পিত কার্যক্রম অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন দেশগুলোকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এর বাইরে যে দেশের গভর্ননেন্স পারফরম্যান্স ভালো থাকবে তারা চাইলেই ঋণ হিসেবে নিতে পারবে। এই ফান্ড থেকে কেনন্দ্রীয় সরকার সরাসরি নিতে না পারলেও ভালো পারফরমেন্স করা স্থানীয় সরকার নিতে পারে। এনজিও এবং কম্যুনিটিভিত্তিক সংস্থাগুলো তহবিল নিয়ে কম্যুনিটি সবুজ উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই সহনীয়তা নিশ্চিত করতে পারে। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা এই বিষয়কে এনসিওর করতে না পারব ততক্ষণ পর্যন্ত ক্লাইমেট ভালনারেবিলিটি কমবে না বরং বিভিন্ন কর্পোরেটদের বিজনেস অপরচুনিটি তৈরি হবে। আমরা যদি সত্যিই মনে করি মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমানো উচিত তাহলে আমাদেরকে এভাবেই এগোতে হবে।

প্রতি কপ সম্মেলনের আগে সরকারের একটি অবস্থানপত্র তৈরি করা হয়। । প্রত্যেক দেশেই কপ শুরু হওয়ার কমপক্ষে দুই মাস আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে এই অবস্থানপত্র তৈরি করা হয়। প্রত্যেক দেশ এই অবস্থানপত্র জনগণের সামনে উন্মুক্ত করে এবং পরামর্শ গ্রহণ করে। পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি,কারণ যত বেশি মানুষ মতামত প্রদান করবে জাতীয় অবস্থান তত বেশি সমৃদ্ধ হবে, গণতান্ত্রিক চ্ররচা শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় জনপরামর্শ গ্রহণে সরকারের নীতিনির্ধারকদের একধরনের অনিহা।

বাংলাদেশের যারা এই অবস্থানপত্র তৈরি করেন তারা এটা মিডিয়াতে বা জনসমক্ষে শেয়ার করেন না। অথচ প্যারিস চুক্তিতে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে ভুক্তভোগী স্থানীয় জনগণের মতামতকে গ্রহণ ও তাকে প্রাধান্য দিতে হবে। জেন্ডার রেস্পন্সিভ হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে সেগুলোর কোনোটিই যথাযথভাবে করা হয় না।

আমরা যখন জলবায়ু তহবিল নিচ্ছি, যখন জলবায়ু অভিযোজন এর প্রকল্প নিচ্ছি তখন চুক্তির প্রত্যেকটা ধারা ইমপ্লিমেন্ট করার বাধ্যবাধকতা আমাদের রয়েছে। প্যারিস চুক্তি মানা আন্তর্জাতিকভাবে যতটুকু বাধ্যতামূলক তার চেয়ে বেশি বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রীয়ভাবে। ক্লাইমেট জাস্টিস এর জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই জায়গায় এসে আমরা গুরুত্ব কম দিচ্ছি। নীতিনির্ধারকরা নির্দেশনা দেয়ার পর অধিদপ্তর থেকে উদ্যোগ কম।

যেকোনো ধরনের পরিবেশ দূষণ বা কার্বন নিঃসরণ এর সমাধান হতে হবে ক্রস বাউন্ডারি। অর্থাৎ আন্তঃদেশীয় সমাধান হতে হবে। কিন্তু পানি, বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে আমরা এ অঞ্চলের জন্য কোন ক্রস বর্ডার এগ্রিমেন্ট করতে পারিনা। ভারতের গঙ্গা নদীতে যখন দূষণ হয় বাংলাদেশ তার ভুক্তভোগী হয়, জাপান বা চীন যখন কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করে তখন বাংলাদেশের জনগন দূষণের শিকার বা ভুক্তভোগী হলেও দেশগুলো আর্থিক সুবিধা নিলেও দূষনের দায় দায় নিচ্ছে না। ক্রস বর্ডার সমাধানের সিদ্ধান্ত ছাড়া এককভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাবস্থাপনা বিজ্ঞানভিত্তিক বা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ অবস্থান। সুতরাং এলডিসি দেশগুলোকে সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের সমন্বিত ব্যাবহার করে টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিতে একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করতে হবে যে, ক্রস বর্ডার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমন ব্রাজিল দাবি করতে পারে আমাজন জঙ্গল তাদের অংশ তারাই একক সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু প্ররথিবীর ফুস্ফুস আমাজন বনের কোন ক্ষতি হলে তার নেতিবাচক প্রভাব সারা পৃথিবীর উপরেই পড়বে। চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের বন শুধুমাত্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জন্য না, বরং সমগ্র বাংলাদেশের এবং এই অঞ্চলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

নীতিনির্ধারকরা যখন বলেন জীবাশ্ম জ্বালানি সস্তা‌ তখন তারা এখানে অর্থনীতির কথা এড়িয়ে যান। অপরচুনিটি কস্ট বিচার করলে জীবাশ্ম জ্বালানি সবচেয়ে বেশি খরচ বয়ে নিয়ে আসে। তেমনি অভিযোজন এর ক্ষেত্রেও একই রকম। অভিযোজনের অর্থ সময়মতো না পেয়ে পাঁচ বছর পরে পেলে অর্থনৈতিক ব্যায় বেড়েজলবায়ু সহনশীলতা অনেক বেশি কস্ট বার্ডেন হয়ে যাচ্ছে।

দেখা গেছে দুর্যোগের পরে সারা পৃথিবীতে যেকোনো দেশের ঋণ গ্রহণের হার বেড়ে যায় ১০০%-২০০% পর্যন্ত। সুতরাং লস অ্যান্ড ড্যামেজ ও এডাপটেশন বাবদ অনুদানের অর্থ সঠিক সময়ে দেওয়া না হলে দেশটি আলটিমেটলি ঋণ-ফাদের দিকে আগাবে। একবার এই ঋণ ফাঁদে পড়লে তা থেকে দেশটি আর বেরোতে পারবে না। ফলে আমরা তো সেটা চাচ্ছি না, আমরা চাই জলবায়ু তহবিল দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে জলবায়ু এবং ঋণ উভয় ফাঁদ থেকে বের করতে।

আমরা যদি ব্যক্তিগতভাবে সচেতন না হই, যদি ব্যক্তিগতভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে সচেতন না হই তাহলে অন্যকে বলার নৈতিক অধিকার থাকে না। কপ-২৮ আমাদেরকে পুনরায় সুযোগ এনে দিয়েছিলো - হয়তো আমরা এনার্জি ট্রানজিশনের দিকে যাব, জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়া হবে এবং একই সময়ে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে। প্যারাডাইম শিফট এর দিকে যেতে হবে অন্যথায় আমরা একটি বৈশ্বিক বিপর্যয়ের দিকে এগুতে থাকবে

আমরা এখন একটি টিপিং পয়েন্টের কাছে রয়েছি। একবার তাতে পৌঁছে গেলে আমরা চাইলেও পৃথিবীর সার্বিক ধ্বংশ থেকে কেউ ফিরতে পারবো না। আমরা যদি যুদ্ধবাজ আর মুনাফাখোরদের কবল থেকে পৃথিবীটাকে সুরক্ষা দিতে পারি তাহলেই পৃথিবী টিকবে এবং এর মানুষ ও প্রকৃতি বাঁচতে পারবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপির হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে হবে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিবে ঢাবি শিক্ষক সমিতি

চাকরি দেবে নোমান গ্রুপ, আবেদন করুন শুধু পুরুষরা

টাকা নিতে অস্বীকৃতি, পোলিং অফিসারকে মারধর

দীপিকার নাম বদলে দিলেন রণবীর

রাইসির মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা পাকিস্তানের

রাইসিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, বললেন ইসরায়েলি নেতা

ইরানকে সহযোগিতায় সবকিছু করতে প্রস্তুত পুতিন

চাচিকে গলা কেটে হত্যাচেষ্টায় যুবক গ্রেপ্তার 

রাইসির মৃত্যুতে পাল্টে যাবে ইরানের পররাষ্ট্রনীতি!

১০

প্রাণ গ্রুপে নিয়োগ, আবেদনের বয়স ৪৫

১১

বদলি হবেন রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও 

১২

সাড়ে ৭ শতাংশ জমির জন্য গৃহবধূকে হত্যা

১৩

রাইসিকে বহনকারী সেই হেলিকপ্টারের ছবি-ভিডিও প্রকাশ্যে

১৪

রাইসির মরদেহ উদ্ধার, পাঠানো হচ্ছে তাবরিজে

১৫

লিচু চাষে বিপর্যয়, হতাশায় বাগান মালিকরা

১৬

টর্নেডোর আঘাতে লন্ডভন্ড শতাধিক ঘরবাড়ি

১৭

ডিপজলের শিল্পী সমিতির দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা

১৮

রাইসিকে কেন ভয় পেতেন ইসরায়েলের নেতারা

১৯

রাইসির মৃত্যুর পর ইরানের পাশে ভারত

২০
X