

প্রজাপতি লেপিডোপ্টেরা বর্গের অন্তর্গত এক ধরনের কীট। সব ধরনের কীটের মধ্যে একমাত্র প্রজাপতিরাই দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বেশিরভাগ প্রজাপতি দিবাচর বলে সহজেই এরা নজর কাড়ে। প্রজাপতির রঙিন ডানা শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই আকৃষ্ট করে।
প্রকৃতি মাতানো তেমনই এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রজাপতি ধুলকাপাস কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিত্যক্ত গাছগাছালি ঘিরে ওড়াউড়ি করতে দেখা গেছে। কয়েকটি ধুলকাপাসের (পুরুষ-স্ত্রী) ওড়াউড়িতে মুখর হয়ে উঠেছিল পরিবেশটা। ফাঁকে ফাঁকে এরা বসছিল ফুলে ফুলে ও পাতায় পাতায়। আবারও উড়ছিল, আবারও বসছিল। তাদের খুনসুটিতে এক স্বর্গীয় আবহের সৃষ্টি হয়েছিল। এই সুন্দর দৃশ্য যেন প্রকৃতির এক অনন্য উপহার।
ধুলকাপাস প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম আপিয়াস লিভিথিয়া। এর ইংরেজি নাম স্ট্রাইপড অ্যালবাট্রস। এরা পিয়েরিডি পরিবারের এবং পিয়েরিনি উপগোত্রের সদস্য। যে পরিবারে সাধারণত সাদা ও হলুদ প্রজাপতি দেখা যায়। এরা একধরনের মাঝারি আকারের প্রজাপতি। প্রসারিত অবস্থায় ধুলকাপাস প্রজাপতির ডানার আকার ৫০ থেকে ৬০ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের হয়।
ধুলকাপাস পুরুষ প্রজাপতির সামনের ডানার শীর্ষদেশ চোখা, কিন্তু স্ত্রী প্রজাপতির ক্ষেত্রে গোলাকার হয়। পুরুষ প্রজাতির ডানার উপরাংশ সাদা এবং ডানার কিনারার দিকে প্রান্তিক খাঁজকাটা কালো ফিতার মতো থাকে। স্ত্রী প্রজাপতির সামনের ডানায় কয়েকটি বিস্তৃত সাদা রেখা ও এক সারি হলুদ উপপ্রান্তিক ফুটকি থাকে। তাছাড়া ডানায় প্রচুর কালো ধূলির মতো থাকে। পুরুষের ডানার নিচটা সাদা ও স্ত্রীর ডানার নিচটা হলদে ধূলিযুক্ত। ডানার শিরাগুলো গাঢ় ধূলিযুক্ত।
ধুলকাপাস প্রজাপতিদের দেশের সর্বত্র দেখা যায়। বিশেষ করে বনের প্রান্তে, উন্মুক্ত পরিবেশে, ঘাসবনে, পরিত্যক্ত জমিতে, এমনকি আবাসিক এলাকায়ও দেখা যায়। বয়স্ক প্রজাপতিরা রৌদ্রময় পরিবেশে বেশি সক্রিয় থাকে। এ প্রজাতির স্ত্রী প্রজাপতিগুলো নিয়মিত ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায় এবং রস ( মধু ) পান করে। খনিজ পদার্থের জন্য পুরুষ প্রজাপতিরা প্রায়ই ভেজা মাটির রস চুষে খায়। এরা পরিযায়ী স্বভাবের হয়ে থাকে।
ধুলকাপাস তাদের জীবনচক্র বরুণ ফুল ও বিভিন্ন প্রজাতির আষাঢ়ী লতা নামক পোষক গাছে সম্পন্ন করে থাকে। স্ত্রী প্রজাপতি গাছের পাতা বা ফুলের ওপর টাকু আকৃতির লম্বাটে ডিম পাড়ে। ডিমের গায়ে লম্বালম্বি খাঁজ ও অসংখ্য আড়াআড়ি রেখা থাকে। এদের ডিমের রং শুরুতে সাদা হলেও রাতারাতি তা কমলা বা হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
ধুলকাপাস প্রজাপতির ডিম থেকে শূককীট বের হতে মাত্র দুদিনের মতো সময় লাগে। এদের দেহে ছোট ছোট লোম থাকে। শুরুতে শূককীটের রং হলুদ থাকলেও ধীরে ধীরে এর রং সবুজ হতে থাকে। শূককীট খাবার হিসেবে প্রথমে অবশিষ্ট ডিমের খোসা খায়। এরপর গাছের পাতা খেয়ে বড় হতে থাকে। এরা এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচবার খোলস বদলায় এবং পরে অর্ধদিনের মধ্যে শূককীট নিজের খোলস পাল্টে মূককীটের শক্ত আবরণে নিজেকে ঢেকে ফেলে।
এরপর মূককীটের শক্ত আবরণে পাঁচ দিন থাকার পর মূককীট খোলস কেটে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে। এদের জীবনচক্র সম্পন্ন হতে ১৪ থেকে ১৬ দিন সময় লাগে। তবে এই প্রজাতির পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতি সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ বেঁচে থাকে।
ধুলকাপাস জাতীয় প্রজাপতি সাধারণত বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ভারত, দক্ষিণপূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও সিঙ্গাপুরে দেখা যায়। এদের সাধারণত শুষ্ক পর্ণমোচী অরণ্যে এবং অনুচ্চ ঝোপ জঙ্গলে দেখতে পাওয়া যায়। এরা সাধারণত ঝোপের মধ্যে ও ঝোপের আশপাশের ফুল ঘিরে ওড়াউড়ি করে ও ফুলে বসে ফুলের মধু খায় ও মাটি থেকে রস চুষে খায়।
কৃষিবিদ মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, স্রষ্টার অনন্য সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম সুন্দর সৃষ্টি রঙবেরঙের চোখজুড়ানো প্রজাপতি। এরা প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে থাকে। এছাড়াও প্রজাপতিরা জীববৈচিত্র্যে বিশেষ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি উদ্ভিদের পরাগায়নে সহায়তা করে থাকে। তবে এদের শুঁয়োপোকা গাছের পাতা খেয়ে জীবনধারণ করে বলে গাছের ক্ষতি হয়।
মন্তব্য করুন