ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৪, ০২:৫৬ এএম
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ০৭:২৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মূল ভাষণ ও সংবিধানে গ্রন্থিত ভাষ্যের বৈসাদৃশ্য

মূল ভাষণ ও সংবিধানে গ্রন্থিত ভাষ্যের বৈসাদৃশ্য

১৯৭১ সালে তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৭ মার্চের ভাষণের কথা শোনেননি বা জানেননি, এমন অজ্ঞান বা জ্ঞানপাপী এখন বাংলাদেশে বিরল। সে ভাষণ এখন দেশের সীমারেখা গড়িয়ে বিশ্ব সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে। ভাষণটি আমাদের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে মূল ভাষণ ও সংবিধানে গ্রন্থিত ভাষণে বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা নিয়ে রিট আবেদন করেন রাজবাড়ীর বাসিন্দা কাশেদ আলী। ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট একটি দৈনিকে খবরটি প্রকাশিত হলে কাশেদ এসব বৈসাদৃশ্য, ভুল বা অমিলের বিরুদ্ধে তার প্রতিবিধান চেয়ে রিট আবেদন করেন। রিট আবেদনকারী ৫৩টি বৈসাদৃশ্য ভুল বা অমিল চিহ্নিত করে রিট করেছিলেন।

১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংবিধানে ভুলভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করে ২০২০ সালের ৫ মার্চ তিনি রিটটি করেন। বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ, সব ধরনের প্রয়োজনীয় নথি, কাগজপত্র ও অডিও পরীক্ষা করে ৭ মার্চের প্রকৃত ভাষণ নিশ্চিতকরণে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে এবং প্রাপ্ত তথ্য আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের পর ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর সাত সদস্যবিশিষ্ট উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়। রিটের আদেশের আলোকে যে কমিটি গঠিত হয় তাতে সদস্য ছিলেন বিটিভির তদানীন্তন মহাপরিচালক এস এম হারুনুর রশিদ, প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ, বাংলা একাডেমির তদানীন্তন সভাপতি শামসুজ্জামান খান, ইতিহাসবিদ লেখক মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক উপপরিচালক আশফাকুর রহমান খান, বাংলাদেশ বেতারের তৎকালীন মহাপরিচালক হোসনে আরা তালুকদার এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স ম গোলাম কিবরিয়া। তাদের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে ২০২২ সালের ১৭ জুন দেশের কতিপয় গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের মূল ভাষণ ও সংবিধানে গ্রন্থিত ভাষণের বৈসাদৃশ্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রিপোর্টটি আদালতেও দাখিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সংবিধানে সন্নিবেশিত ও উত্থাপিত রিপোর্টে কমিটি ১০৯ ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণতা বা অমিল চিহ্নিত করেছে।

২০২২ সালের ১৭ জুন প্রতিবেদনটি দুটি দৈনিকে পড়ার পর আমার মনে একজন বিশেষ ব্যক্তির ছবি ভেসে উঠল। তিনি জার্মান প্রবাসী মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ারদার। তিনি ‘৭ মার্চের ভাষণ জানা অজানা তথ্য’ শিরোনামে ৩৬১ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা অক্টোবর ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি সংবিধানে গ্রন্থিত ভাষণটিতে কমপক্ষে ৬৩টি অমিল, বৈসাদৃশ্য, মিথ্যা তথ্য বা সম্পাদিত তথ্য পেয়েছেন। আমি তার গবেষণার কতিপয় তথ্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি।

তিনি উল্লেখ করেছেন, মূল ভাষণটির স্থিতিকাল হচ্ছে ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড। জোয়ারদার ১১৭টি প্রতিবেদন পর্যালোচনায় ২৭টিতে ভাষণটির স্থিতিকাল পেয়েছেন ১৭ মিনিট, ২৫টিতে ১৮ মিনিট, ৪৭টিতে ১৯ মিনিট, ১৮টিতে ২০ মিনিট পেয়েছেন। সর্বাধিক সংখ্যক ৪৭টি প্রতিবেদনে আমার লেখাটি পর্যালোচিত হলে তার সংখ্যা হতো ৪৮ (লেখক আমার লেখাটি কী কারণে এড়িয়ে গেলেন জানি না। ৭ মার্চ সম্পর্কে সম্ভবত আমার লেখাটিই ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর প্রথম নির্মোহ পর্যালোচনা)। এই স্থিতিকালের সঙ্গে বিভিন্ন স্লোগানে ব্যয়িত সময়ে, একটি বিমান নিঃসারিত শব্দ ও বঙ্গবন্ধু দুবার ‘আপনারা বসুন’, উচ্চারণে ব্যয়িত সময় যোগ করলে ভাষণটির স্থায়িত্ব হয় ২৩ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড; যদিও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তা পেয়েছে ২২ মিনিট ১৮ সেকেন্ড।

উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি ১০৯টি ভুল, অসংগতি কিংবা বিকৃতকরণ আবিষ্কার করে তাদের রিপোর্ট পেশ করেছেন, তবে ভাষণটি থেকে কত শব্দ বিভিন্ন স্থানান্তরে বাদ পড়েছে তা বলেছেন কি না জানি না; যদিও জোয়ারদার সংবিধানে সংযোজিত ভাষণে প্রায় ৭০০ শব্দ বাদ পড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। সব ধরনের অমিল ও বৈসাদৃশ্য সম্পাদনাজনিত অংশ অন্তর্ভুক্ত করে তিনি সম্পূর্ণ ভাষণটি তার গ্রন্থে সংযোজিত করেছেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে, অভাবিত পরিস্থিতির কারণে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর জোয়ারদার ১৯৮৫ সালে এ ভাষণটি প্রথম শোনেন। তারপর বিভিন্ন উৎসে মুদ্রিত ভাষণটি পাঠ করেন বা শোনেন। আমাদের পবিত্র সংবিধানে প্রথিত ভাষণটি বিশ্লেষণ করেন। তার দৃঢ় প্রত্যয় জাগে যে, এই ভাষণটি যেভাবে সংবিধানে সংরক্ষিত আছে, তা ইতিহাস বিকৃতির নামান্তর। তার বিশ্বাসের স্বপক্ষে তিনি প্রায় ৯ বছর ধরে ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন। প্রায় তিন বছর সংসার ধর্ম ছেড়ে একান্ত একাগ্রতা নিয়ে তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে অনেক অনুসিদ্ধান্ত ও উপসংহারে উপনীত হয়েছেন।

তথ্যের ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত এসেছেন যে, ভাষণটির স্থায়িত্ব ১৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড এবং প্রায় ৭০০ শব্দ বাদ দিয়ে সম্পাদিত রূপ প্রকাশ করা হয়েছে। এসব হারামানিক সন্ধানে তিনি যে গবেষণা কৌশল ও উৎস ব্যবহার করেছেন, তা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তাদের রিপোর্ট প্রণয়নে প্রায় সবকটি ব্যবহার করেছে। তদুপরি তিনি বহুসংখ্যক বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং সেদিনে রেসকোর্সে উপস্থিত ছিলেন এমন বিশেষজ্ঞের লেখা বা সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আরও উপসংহার টেনেছেন, বঙ্গবন্ধু সেদিন পূর্বনির্ধারিত পথ বদলে রেসকোর্সে হাজী মোরশেদের গাড়িতেই (গাড়ি নম্বর ঢাকা ১) আসা-যাওয়া করেছেন। গাড়ির পেছনের সিটে তার নিরাপত্তাকর্মী মহিউদ্দিন ও গাজী গোলাম মোস্তফা বসা ছিলেন। এ সভায় কোনো সভাপতি ছিলেন না, কিংবা কোনো সঞ্চালক ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু বক্তব্য শুরু করেন ৩টা ২০ মিনিটে এবং শেষ করেন ৩টা ৪২ মিনিটে। তার তথ্যমতে, স্লোগান বা এ জাতীয় ডিস্টারবেঞ্চের কারণে ব্যয়িত সময় বাদ দিলে ভাষণের স্থিতিকাল ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড। রেসকোর্সে যাওয়ার পথে হাজী মোরশেদ নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—‘আজকে আপনি কী বক্তব্য দেবেন?’ বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল—‘আমার মুখ দিয়ে আল্লাহ যা বলাবে তা-ই বলব।’ মনে হয় তাই আল্লাহ দুবার তার মুখ দিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা বলিয়েছেন; একবার ভাষণের সাড়ে ৮ মিনিটের মাথায় আর একবার বক্তব্যের প্রায় শেষে।

বিটিভিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের যে ভিডিওটি রয়েছে, তা মাত্র ১০ মিনিটের, অন্যদিকে বাংলাদেশ বেতারে যে ক্যাসেটটি রয়েছে, তা ১৮ মিনিটের। এই দুয়ের গরমিলটা জোয়ারদার উদ্ঘাটন করেছেন। সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছে ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের বক্তব্য, কবীর চৌধুরী সম্পাদিত ভিডিওর দৈর্ঘ্য ১৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ড; তবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ১৩ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের। তাহলে কি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি উত্থাপিত বিতর্কের কোনো সমাধান দিতে পেরেছে?

বঙ্গবন্ধু ৩টা ২০ মিনিটে ‘ভায়েরা আমার’ বলে বক্তব্য শুরু করেন এবং জয় বাংলা বলে বক্তব্য শেষ করেন। তথ্য-প্রমাণাদি দিয়ে জোয়ারদার প্রমাণ করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলেই বক্তব্য শেষ করেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, ভাষণটিতে ৫৭টি ইংরেজি শব্দ ১০৬ বার ব্যবহার করা হয়েছে, পুনরাবৃত্তি বা পূর্ণ উচ্চারিত শব্দের সংখ্যা ৯টি; ১৯ বার তিনি এমন কিছু শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেছেন, যাতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক মনে হয়েছে। ভাষণে ৯টি প্রশ্নবোধক বাক্য ছিল।

আমার ধারণা, জোয়ারদারের প্রতিবেদনটিকেও বিনা বাক্যব্যয়ে গ্রহণ প্রশ্নবোধক থেকে যাবে। আমার আরও ধারণা, সরকারি কমিটি জোয়ারদারকে বিশেষ সাক্ষী হিসেবে তলব করতে পারত কিংবা তার প্রকাশিত বইটির একটা নিবিড় বিশ্লেষণ করতে পারত। জোয়ারদারের পরামর্শ অনুযায়ী দেশের ৫০ জন পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও আমলাদের নিয়ে সরকার একটি কমিটি গঠন করতে পারত। তাতে প্রতিবেদনটির গুণগত মান বাড়ত। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো সন্তোষজনক সমাধান হতো।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ঢাবির শিক্ষক থাকাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বর্তমানে তিনি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চীনে পৌঁছেছেন পুতিন

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন দিবস / শুক্রবার আ.লীগের একগুচ্ছ কর্মসূচি

সোনারগাঁয়ে ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘পাগলা গাছ’র মেলা

সুখবর নেই ঢাকার বাতাসে

সিনিয়র সহকারী সচিব হলেন ২০১ কর্মকর্তা

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে তুলাধুনা হলেন নেতানিয়াহু

ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার এই চিত্র কি আল্লাহর রহমত?

মেসিহীন মায়ামি গোলও পায়নি

‘আমরা জীবনের আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম’

নীরবতা ভেঙে যা বললেন সাইফউদ্দিন-মিরাজ

১০

ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে রেডিওলজি যন্ত্রপাতি পরিদর্শন জাপান উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর

১১

রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিক্রি করছে পাকিস্তান

১২

‘কমলা ভাসিন অ্যাওয়ার্ডের’ জন্য আবেদকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ

১৩

দেশে ফিরতে শুরু করেছেন বাস্তুচ্যুত সিরিয়ানরা

১৪

গাজীপুরে পুড়ে ছাই অর্ধশতাধিক ঘর

১৫

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দেশসেরা খুবি

১৬

বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২

১৭

বিটিআরসির অভিযান / ৯৭৭ অবৈধ স্মার্ট টিভি বক্স জব্দ, আটক ৪

১৮

হিমাগারে মজুত ছি‌ল ৫ লাখ ডিম

১৯

১৬ মে : নামাজের সময়সূচি

২০
X