মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৬ এএম
আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংবাদপত্রবিহীন দেশ

সংবাদপত্রবিহীন দেশ

আগে শুনেছি নিয়োগকারীরা শ্রমিকদের ধর্মঘটে অতিষ্ঠ হয়ে লকডাউন করে। কিন্তু এখন চোখে দেখলাম, নিয়োগদাতারা ধর্মঘট করে বসে আছেন। তাও একটানা ছয় দিন। শ্রমিকদের ধর্মঘটে সরকার হস্তক্ষেপ সাধারণত করে না, তবে অতি প্রয়োজনীয় সেবা খাতে তা নিষিদ্ধ। এসব সেবা খাত যেমন বিদ্যুৎ, পানি, চিকিৎসা, যোগাযোগব্যবস্থার সঙ্গে সারা বিশ্বে অভ্যাসজনিত অতি প্রয়োজনীয় সেবা খাত হচ্ছে সংবাদপত্র। একটা সময় ছিল সংবাদপত্র বিলম্বে হাতে এলে আমাদের হাপিত্যেশ শুরু হয়ে যেত। এখন তা অনেকটা গা-সহা। আগে হকার রোদ ওঠার আগেই সংবাদপত্র হাতে পৌঁছে দিত; সংবাদপত্র পড়ে, তবে ঘর থেকে বের হতাম। এখন বাসায় ফিরে সংবাদপত্রে চোখ বুলিয়ে দেখি। অনুভব করি এরই মধ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে কিংবা মোবাইল ফোনের কৃপায় সব খবর প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। তারপর যা খুঁজি তা কিন্তু সংবাদ নয়, সংবাদভাষ্য বা মতামত। তার মানে সংবাদপত্রের চাহিদা এখনো আছে। এর চাহিদা আছে সংবাদপত্রে যারা কলাম লিখে কিংবা গল্প-প্রবন্ধ, কবিতা লিখে কিংবা ভিন্নমত পোষণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনুসন্ধানভিত্তিক প্রতিবেদন বা নীতিবিষয়ক খবরগুলো কিন্তু আজও অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে পড়ি। তবে এখন প্রিন্ট মিডিয়ার মতো ইলেকট্রনিক মিডিয়াও চোখ-কানকে আলোড়িত করে। তাই শব্দের সমন্বয়ে বাক্য বিন্যাসের সংবাদপত্র চাহিদা হারাচ্ছে। সংবাদপত্র শিল্পে অনেকের ত্রাহি-ত্রাহি সুর; অনেকে পত্রিকা ছাপায় স্রেফ বেঁচে থাকতে কিংবা সাংবাদিকদের বাঁচিয়ে রাখতে। কেউ কেউ ছাপেন বিজ্ঞাপন পেতে কিংবা নিউজপ্রিন্টের কোটা বজায় রাখতে। কেউ কেউ অবশ্য সংবাদপত্র ছাপিয়ে মুনাফা করেন। তবে কেউ কেউ দিনে দিনে লোকসান দিয়েও সংবাদপত্র ছাপেন। কেননা, সংবাদপত্র তার বা তাদের হাতে এক ধরনের হাতিয়ার। এ হাতিয়ার দিয়ে সবার উপকার করা না গেলেও সবাইকে যে কমবেশি ঘায়েল করা যায়, তা কমবেশি চোখে পড়ে।

উপর্যুক্ত সব শ্রেণির সংবাদপত্রের মালিক ছয় দিন ধরে ধর্মঘটে রয়েছেন। তারা কী লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। আমি দেখলাম তাদের অনলাইন মুদ্রণ অব্যাহত আছে। তাদের অনেকেই আবার ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক। তাদের পরিবেশিত খবরাদি ক্ষণে ক্ষণে হাতে পেয়ে সংবাদপত্রের অভাব খুব একটা অনুভব করিনি। তার পাশে আছে ব্যক্তিগত সংবাদপত্র মানে ফেসবুক। ফেসবুকে অনেক জঞ্জালে ভরা। তারপরও চোখ বুলাই, কারণ ‘নাই কাজ, তাই খই ভাজ’। তবে কিছুটা কষ্ট লাগেনি যে তা নয়। কষ্ট লেগেছে যারা সংবাদপত্রে লিখে জীবিকা নির্বাহ করেন কিংবা যারা হকারি করে সংসার চালান। ফেসবুকে দেখলাম, একজন লিখেছেন, ‘আমার একটি খেলনা কিনলে আপনার শিশু আনন্দ পাবে আর আমার শিশুটি দুটো ভাত খাবে।’ কথাটার সুর এ ক্ষেত্রেও অনুরণিত। ঈদে চাঁদে হকাররা একটু বেশি আয় উপার্জন করে। এবার মাসের ৮ তারিখে ঈদের সংখ্যা কেউ কেউ ছেপে ফেলেছেন। আর পাঠক জেনেছে আগামী ছয় দিন পত্রিকা আসবে না। তাই ৮ তারিখের পর হয়তো লজ্জাবনত হকাররা বকশিশ নিতে আসেনি। আর কেউ কি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন? আমার ধারণা, পাঠকমহলে এক ধরনের বিক্ষুব্ধতার জন্ম হয়েছে। এ পাঠকরা আগের প্রজন্মের। তাদের কাছে কিছুদিন বা ঘটনা অসীম মূল্যবান। ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিন। আজ কজনা জানে যে আগরতলায় এ সরকার এই দিনে গঠিত হয়েছিল। সংবাদপত্র থাকলে আর সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধ, গল্প-কবিতা ছাপা হলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারত, বুঝতে পারত, মৌলবাদদের মোকাবিলার শক্তি সঞ্চয় করতে পারত। ১১ তারিখে ছিল ঈদ। ঈদের তিন দিন আগে ঈদসংখ্যা প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে খর্বাকৃতি করা হয়েছে। কেউ কেউ দায়সারা গোছের কিছু একটা করেছে। তারপর থেকে সংবাদপত্রবিহীন দেশ। ছয় দিন ধরে সংবাদপত্র ছিল না, এমন দেশ খুঁজে পাওয়া ভার। গিনেস রেকর্ড বুক তাদের প্রকাশনার বহর বাড়াতে আরেকটি সংবাদ পেয়ে গেল।

এ দেশে কোনো গোষ্ঠী যখন দুটো বোনাসসহ দীর্ঘ ঈদ করতে পারে, তাহলে সাংবাদিকরা সবেতনে ছয় দিন ছুটি ভোগ করলে আপত্তিটা কোথায়? তবে নিউটনের ভাষায় প্রত্যেক কাজেরই সমপরিমাণ বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া থাকে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য তা নয়। ১ বৈশাখও সংবাদপত্র থাকবে না, তা একালে ঘটলেও পরাধীন দেশে ঘটেনি।

কেউ কেউ বলছেন, সংবাদপত্র ছয় দিন কেন, ছয় মাস বন্ধ থাকলেও কারও তেমন হাপিত্যেশ থাকবে না। তারা হয়তো ক্রস ইলাস্টিসিটির কথা বলছেন। যেমন চিনির সরবরাহ অস্বাভাবিক কমে গেলে কেউ কেউ গুড় দিয়ে চিনির অভাব মোচন করে; যাকে বাংলায় বলে ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’। আমাদের কালের মানুষের কাছে দুধ দুধই আর ঘোল ঘোলই। ভবিষ্যতে আমাদের মতো বিলীয়মান প্রজন্মটা ধরে রাখতে এবং তাদের ও তাদের অনুসারীদের চাহিদা মেটাতে জাতীয় দিবসগুলোর মতো প্রতিদিনই সংবাদপত্র ছাপানো বাঞ্ছনীয়। কারণ এ প্রজন্মটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা কমবেশি ধারণ করেছে। যাদের হাতে ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা মোবাইল ঠাঁই পেয়েছে, তারা ১ বৈশাখের মতো সার্বজনীন উৎসব পালনকে শয়তানের কুতকুতি বলতে শিখছে; পান্তা-ইলিশের বদলে পান্তা-গো-মাংস খাওয়ার পরামর্শ গলাধঃকরণ করছে। তাদেরই কেউ কেউ রাসবিহারী ঘোষের দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। সংবাদপত্র না থাকলে আর সংবাদপত্র তার আদি ও অকৃত্রিম ভূমিকা পালন অব্যাহত না রাখলে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের উত্তরাধিকার পাওয়া কঠিন হবে।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তীব্র তাপদাহে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দেশনা

ভয়াল ২৯ এপ্রিলের স্মরণে ঢাকাস্থ কক্সবাজার সমিতি

মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যু

মঙ্গলবার কেমন থাকবে আবহাওয়া?

সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে নারীর জরায়ু কাটার অভিযোগ

রাজবাড়ীতে বিদ্যুৎস্পর্শে একজনের মৃত্যু

বঙ্গবন্ধু মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন

পাবিপ্রবিতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন

বাজারে গিগাবাইটের এআই পরিচালিত ইন্টেল ১৪ জেনারেশন ল্যাপটপ

চিকিৎসা শেষে পথেই প্রাণ গেল ৪ জনের

১০

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রাকচাপায় কলেজছাত্র নিহত

১১

উপজেলা নির্বাচনে আ.লীগ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

১২

এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট

১৩

৩ সাংবাদিকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে সাইবার মামলা

১৪

উচ্চ শিক্ষায় ফিলিস্তিনের নারী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে আইইউবিএটি

১৫

দেশ এখন ভয়াবহ সংকটে রয়েছে : গণঅধিকার পরিষদ

১৬

মুক্তি পেতে যাচ্ছেন মামুনুল হক 

১৭

স্বাধীন তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের মুখোশ উন্মোচনের দাবি পরশের

১৮

গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ধানের ফসল কর্তন উৎসব

১৯

কক্সবাজারে ডাকাতদলের সঙ্গে র‍্যাবের গোলাগুলিতে নিহত ১

২০
*/ ?>
X