ড. সেলিম জাহান
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:২৩ এএম
আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রসঙ্গ ব্যাংক একীভূতকরণ

প্রসঙ্গ ব্যাংক একীভূতকরণ

সংবাদে প্রকাশ যে, আরও তিনটি দুর্বল ব্যাংক তুলনামূলক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) একীভূত হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে। একীভূতকরণ নিয়ে এই চার ব্যাংকের মধ্যে চলতি সপ্তাহে চুক্তি হতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংক একীভূত হতে যাচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। ঈদের পরই ব্যাংক দুটির মধ্যে একীভূতকরণ চুক্তি হতে পারে বলে জানা গেছে। এর আগে পদ্মা ব্যাংক একীভূত হয়েছিল এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে।

বর্তমান একীভূতকরণের পর আলোচনায় রয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, আরব-বাংলাদেশ ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবং বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। এভাবে একীভূতকরণের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকের সংখ্যা ৪৪টি করা হতে পারে বলে জানা গেছে।

সারা বিশ্বে ব্যাংক, শিল্প কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণ নতুন কিছু নয়। নানান অর্থনীতিতে নানান সময়ে এটা ঘটেছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক টালমাটালের সময়। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময়েও এটা আমরা লক্ষ করেছি। সাধারণত তিনটে কারণে এ জাতীয় একীভূতকরণ ঘটে থাকে। এক. ক্ষমতার বলয় প্রসারণের জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আত্মভূত করে থাকে; দুই. প্রতিযোগিতাকে হ্রাস করে একচেটিয়া বাজার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাস করে এবং তিন. আর্থিক সমস্যাসংকুল নানান প্রতিষ্ঠানকে অন্যান্য ভালো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করে বাজারে স্থিতিশীলতা ও আস্থা নিশ্চিত করা হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে যে, বাংলাদেশে একই সঙ্গে এতগুলো ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলো কেন? কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ব্যাংকের সংখ্যা মোট অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং বজায় ক্ষমতার জন্য, দক্ষতার জন্য, সেবার মান বাড়ানোর জন্য এ সংকোচন অপরিহার্য ছিল। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকটি ব্যাংকের সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি পুরো ব্যাংক খাতকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। সৃষ্টি হয়েছে উচ্চখেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি। সেইসঙ্গে অনাস্থা, তারল্য সংকট বেড়েই চলেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে। অনেকেই বলছেন যে, বর্তমান সময়ে ব্যাংক খাতে যে সমস্যা এবং অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান, সেটাকে হ্রাস করার জন্যই এ একীভূতকরণ। সেইসঙ্গে এটাও বলা হচ্ছে যে, অর্থনীতিতে আস্থা বৃদ্ধির জন্য এটার প্রয়োজন ছিল। কেউ কেউ মত দিয়েছেন যে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর জন্যই এ পদক্ষেপ। তবে অনেকেরই আশঙ্কা, একীভূত করার মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি দেওয়া হতে পারে। এটাও শোনা যাচ্ছে, বর্তমানে পুরো ব্যাংকিং কাঠামো ভঙ্গুর ও নাজুক। সুতরাং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে যদি একীভূত না করা হয় এবং তারা যদি গনেশ ওল্টায়, তাহলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটা টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

সাধারণভাবে বাংলাদেশে ব্যাংকসমূহের একীভূতকরণ সম্পর্কে পাঁচটি কথা মনে রাখা দরকার। প্রথমত, প্রতিযোগিতা ও দক্ষতার নিয়মে সাধারণ কোনো ব্যাংক যদি আর্থিক দিক থেকে অকৃতকার্য হয়, তাহলে তাকে স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হতে দেওয়া ভালো। যদি না সে ব্যাংকটি এমন বড় ও গুরুত্বপূর্ণ হয় যে তার বিলোপ পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার সামষ্টিক স্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে।

দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ব্যাংকের একীভূতকরণ যদি একচেটিয়া বাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হয়, তবে তা পরিত্যাজ্য। একচেটিয়া বাজার গ্রাহককে প্রতিযোগিতামূলক সেবা দেবে না এবং এর ফলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেইসঙ্গে ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ ঘটলে তা সামগ্রিক অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও কীরকম প্রভাব ফেলবে, তাও মূল্যায়িত হওয়া দরকার। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে বর্তমান ব্যাংক খাতে যেসব মৌলিক সমস্যা রয়েছে, তার জন্য কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। সেসব কষ্টকর কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিকল্প একীভূতকরণ হতে পারে না।

চতুর্থত, ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ ঘটলে দুর্বলতর ব্যাংকটির কর্মীদল, তাদের কর্ম নিরাপত্তা, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

পঞ্চমত, একটি অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটে একটি ব্যাংক খাতের অনুকূল সংখ্যা আছে। মোট ব্যাংকের সংখ্যা সে সংখ্যাকে অতিক্রম করে গেলে সেখানে একটি নাজুকতার জন্ম হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নাজুকতা ও অস্থিতিশীলতা থাকা সত্ত্বেও কেন নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, তা পর্যালোচিত হওয়া প্রয়োজন। অন্য ভাষায়, একীভূতকরণের (অর্থাৎ ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা) মাধ্যমে যখন ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য সুরক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেখানে নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমোদনের যৌক্তিকতা কোথায়?

এ ভিন্ন তিনটি বিষয়ের ওপরও দৃষ্টি দেওয়া দরকার। এক, দুর্বল ব্যাংকগুলো শুধু বেসরকারি খাতেই নয়, সরকারি খাতেও আছে। যেমন—একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। সুতরাং ব্যাংক নাজুকতা সব খাতেই রয়েছে। দুই, বিশ্বব্যাংকও ব্যাংক একীভূতকরণের পরামর্শ দিয়েছে এবং এ প্রক্রিয়াকে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে না দিতে অনুরোধ করেছে। বলা প্রয়োজন, আশির দশকে আর্থিক খাত সংস্কার বিশ্বব্যাংকের সুপরামর্শে এবং প্রত্যক্ষ কার্যক্রমের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। কিন্তু নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছি? এ দায়ভাগে ওই প্রতিষ্ঠানটির অংশীদারত্ব কত, তাও যাচাই হওয়া দরকার।

তিন, একীভূতকরণের সপক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যই এটা করা হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা হয়েছে যে, একীভূত দুর্বল ব্যাংকগুলোর কর্মচারীদের চাকরি সুরক্ষিত এবং কাউকেই ছাঁটাই করা হবে না। সেইসঙ্গে সেসব ব্যাংকের আমানতকারীদের বলা হয়েছে যে, তাদের আমানত নিরাপদ। সার্বিকভাবে একটি স্থিতিশীলতার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের জন্য নতুন। এর নানান মাত্রিকতা এবং সম্ভাব্য প্রভাব তাই সুষ্ঠুভাবে নিরূপিত হওয়া দরকার। একটি যান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে বিষয়টি একটি প্রয়োগিক এবং মানবিক প্রেক্ষিত থেকেও দেখা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে পুরো ব্যাপারটি একটি সামগ্রিক আর্থিক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে দেখতে হবে।

লেখক: ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিক্রি করছে পাকিস্তান

‘কমলা ভাসিন অ্যাওয়ার্ডের’ জন্য আবেদকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ

দেশে ফিরতে শুরু করেছেন বাস্তুচ্যুত সিরিয়ানরা

গাজীপুরে পুড়ে ছাই অর্ধশতাধিক ঘর

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দেশসেরা খুবি

বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২

বিটিআরসির অভিযান / ৯৭৭ অবৈধ স্মার্ট টিভি বক্স জব্দ, আটক ৪

হিমাগারে মজুত ছি‌ল ৫ লাখ ডিম

১৬ মে : নামাজের সময়সূচি

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১০

চাঁদপুরে ৫ ভুয়া ডিবি পুলিশ আটক

১১

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১২

ফিলিস্তিনি নেতাদের সঙ্গে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ

১৩

কলকাতায় এখন মণিপাল হসপিটাল / সাধ্যের মধ্যে ক্যান্সার, লিভার ও কিডনি রোগের চিকিৎসা

১৪

সাংবাদিককে হত্যাচেষ্টা মামলায় ১ জনের কারাদণ্ড, জরিমানা

১৫

ছিটকে পড়ে প্রাণ গেল চালকের

১৬

আ.লীগের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

১৭

স্যাম বন্ড ব্র্যান্ডের পরিবেশক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

১৮

জাতীয় এসএমই মেলা শুরু ১৯ মে

১৯

‘সর্বনাশ করেছে গণিতের শিক্ষক’

২০
X