সব দেশে সবকিছু মানানসই নয়। কথায় বলে, এক দেশে যা বুলি, আরেক দেশে তা গালি। এক দেশে যা বর্জিত, আরেক দেশে তা সমাদৃত। এ প্রসঙ্গে আগে একটি গল্প বলে রাখি। একবার ইউরোপের কয়েকজন মানুষের কাছে গর্বের সঙ্গে বললাম ইলিশ মাছের কথা। বাঙালির ইলিশপ্রীতির কথা, ইলিশের সুঘ্রাণ এবং স্বাদের কথা কিছুই বাদ রইল না। বললাম, ‘এ জগতে ইলিশের ওপর কোনো মাছ নেই! আমরা বলি ইলিশ হলো মাছের রাজা! সেই তুলনায় তোমাদের স্যালমন, বারবুনিয়া বা তুনা প্রজা মাত্র।’ অবাক হয়ে শুনে তাদের মুখে জল চলে এলো। ইলিশ খাবার স্বাদ জাগল। কয়েকদিন পর বাজার থেকে বড় ইলিশ কিনে এনে তাদের দাওয়াত দিলাম। তারা ছুটে চলে এলো বাঘ যেমন হরিণ খাওয়ার জন্য ছোটে—তেমনি। বাংলার ইলিশ খাবে! ইলিশের ঘ্রাণে ঘর ময়ময় করছে। বুক ফুলিয়ে ভাবলাম, এমন ঘ্রাণ ছুটেছে, যাক ভালো ইলিশ কিনতে পেরেছি। জেলে সমুদ্রের ঘ্রাণহীন, তেলহীন লম্বা ইলিশ ধরিয়ে দেয়নি। কিন্তু খাবার ঘরে ঢুকেই সাদা চামড়ার অতিথিরা নাকটা যেন সুচোর মতো টানতে থাকল। অতি উৎসাহী ইলিশ ভক্ত বাঙালি সবার পাতে বড়বড় ইলিশ টুকরো তুলে দিলাম। গর্ব করে বললাম, ‘সাবধান কাঁটা আছে কিন্তু! জানো তো, যে ফুলে কাঁটা বেশি, সে ফুলের কদর বেশি!’ তারা ‘ঠিক ঠিক’ বলে মাছ ভেঙে মুখে তুলল। ওমা! মনে হলো আমি যেন তাদের প্লেটে কাঁচা বিষ্ঠা তুলে দিয়েছি! ওরা যথাযথ ভদ্রতা রক্ষা করে বিড়বিড় করে বলল, ‘সরি, ভীষণ বোটকা গন্ধ, এ মাছ খাওয়া সম্ভব নয়!’
দুঃখে মনটা ভার হয়ে গেল। হায়রে ইউরোপিয়ান, ইলিশের স্বাদ থেকে এভাবে বঞ্চিত হলে! কী আর করা, নিজেকে প্রবোধ দিয়ে স্মরণ করলাম মুজতবা আলীকে, ‘আহারাদির ব্যাপারে ইংরেজ নকিষ্যি কুলীনের মতো উন্নাসিক, কট্টর স্বপাকে খায়, এদেশে এতকাল কাটানোর পরও ইংরেজ মাস্টার্ড (সর্ষে বাটা বা কাসুন্দি) এবং মাছে মিলিয়ে খেতে শেখেনি, অথচ কে না জানে শর্ষে বাটায় ইলিশ মাছ খাদ্যজগতে অন্যতম কুতুব মিনার?’
যাক, জোর করে তো আর কাউকে গলাধঃকরণ করানো যায় না। বুঝতে হয়, যার যার রীতিনীতি, যার যার পরিবেশ কালচার, স্বাদ-গন্ধ এমনকি যার যার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পরিকল্পনা সবকিছু ভিন্ন হয়ে থাকে। সেটা মাথায় রেখেই কোনটা ভালো আর কোনটা অনুকরণ করা উচিত নয়, তা বুঝে নিতে হয়। না বুঝলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। যেমন, পোপ ফ্রান্সিস ১০ মে শুক্রবার ইউরোপে জন্মহার কমে যাওয়ার কঠোর সমালোচনা করে জ্বালাময়ী এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘একজন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ আমাকে একটি সত্য কথা বলেছেন। এ মুহূর্তে অস্ত্র কোম্পানি এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ কোম্পানিগুলো আমাদের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব দিচ্ছে। এর একটি জীবনকে ধ্বংস করছে, আরেকটি জীবনকে প্রতিহত করছে।... আমাদের ঘরবাড়িতে সুন্দর জিনিসপত্রের কোনো অভাব নেই, কুকুর আছে, বিড়াল আছে, নেই শুধু শিশু।’
৮৭ বছর বয়সী পোপের কথা ইতালি এবং ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশের জন্য চরম বাস্তবমুখী। ওইসব দেশে গত দশ বছরে জন্মহার নেমে গেছে ১.৫। অথচ জনসংখ্যার ভারসাম্যের জন্য গ্রোথ রেট প্রয়োজন কমপক্ষে ২.১। এই কম শিশু জন্মের কারণে ওইসব দেশে ৬-৭ শতাংশ হারে শিশুর জন্ম হচ্ছে। অথচ মৃত্যুর হার বছরে ১১ শতাংশ। ইতালির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৩ শতাংশ। অন্যদিকে কর্মঠ প্রজন্ম কমে যাচ্ছে, ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে অবসর জীবনে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ইতালি, রোমানিয়া, মালদোভা, পূর্ব এশিয়ার জাপানের মতো দেশগুলোতে ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা কমে যাবে ১৫ শতাংশ!
সুতরাং পোপের ওই বক্তব্য ওই দেশগুলোর জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু নাইজার, কঙ্গো, গ্যাবন, জাম্বিয়া, মালি, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জন্য রীতিমতো পাপ। অন্য দেশের কথা নাইবা বলি। বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ হয়েছে। পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ন্যাশনাল প্রসপেক্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৪৭ লাখ (অন্য একটি সংস্থার মতে ১৭ কোটি ৭০ লাখ। ধারণা করি, এই হিসাব থেকেও প্রায় ১ কোটি মানুষ বাদ পড়েছে। হাজার হাজার বস্তির সঠিক হিসাব নেই, ইন্টারনাল মাইগ্রেশনের খবরও কেউ রাখে না।)। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের কাছাকাছি আসায় এবং সরকারের প্রচেষ্টায় শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ফলে মানুষ বাড়ছে জ্যামিতিকে হার মানিয়ে! যারা বলেন জনসংখ্যা কোনো সমস্যা নয়, তারা হয় চিন্তা না করে বলেন, অথবা মতলববাজ। তারা বলেন, ‘জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে!’ এত সোজা? পেরেছেন করতে? এই ডায়ালগ তো শুনে আসছি ৩০ বছর ধরে। মানবেতর জীবনযাপন করতে মানুষ জমি বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিচ্ছে। বাধ্য হচ্ছে কর্মের সন্ধানে মাত্র ১০-১৫ হাজার টাকা বেতনে মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে দুবাই-কাতার গিয়ে পড়ে থাকতে। একে জনশক্তি বলে? জনসংখ্যার পক্ষের বক্তারা কী করেছেন! দেশে ৬৫ লাখ কর্মঠ মানুষ বেকার, জানেন কি? জানেন নিশ্চয়ই, কিন্তু চুপ করে থাকেন।
যারা জনশক্তিতে রূপান্তর করার ফাঁপা আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের একাধিক নেপথ্য উদ্দেশ্য আছে। এর একটি হলো, দেশে পরিবার পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে গেছে, সেটা যেন চোখে না পড়ে। রক্ষণশীল উগ্র কিছু মানুষ পরিবার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় সরকার আর এ প্রোগ্রামকে শক্তিশালী করতে চেষ্টা করেনি। দেশের বহু জায়গায় স্থানীয় কিছু মানুষ পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে। বিগত দিনে বহু জেলা উপজেলায় অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে। এখন অফিস ও কর্মচারীরাই পড়ে আছেন শুধু। মাস গেলে বেতন পাচ্ছেন। পরিবার পরিকল্পনার যে আনুষ্ঠানিক হিসাব দেওয়া হয়, তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবতা বিবর্জিত।
ফলে কী হচ্ছে? ঘনবসতিরও একটি সীমা থাকে। বাংলাদেশ সে সীমা অতিক্রম করেছে অনেক আগেই। বহুকাল ধরেই বাংলাদেশের ঘনবসতির ধারে কাছে কোনো দেশ নেই। যে কয়েকটি শহরে ঘনবসতি আছে, সেগুলো পুরো দেশ নয়। ম্যাকাও বা সিঙ্গাপুর শহরভিত্তিক। এই অতিরিক্ত ঘনবসতির কারণে দেশের ফুল-ফল, বন্যপ্রাণী সব বিলীন হয়ে গেছে। দেশের কোনো নদীতে, খালে মাছ নেই। মানুষ এখন চাষের মাছে খায়। দু-তিন দশক আগেও পুকুরে, ডোবায়, খালে-বিলে থাকত কই, মাগুর, শিং, খলিশা, ভ্যাদা, চিতল বোয়াল, পাবদা। এখন সব চাষ করা হয়। এর প্রধান কারণ মানুষ আর মানুষ! কচু-ঘেচু পর্যন্ত দামি খাবার হয়ে গেছে। মানুষ গোগ্রাসে খাচ্ছে। বনগরু, মেছোবাঘ, ভোদর, বনবিড়াল, ঘড়িয়াল, বানর, কচ্ছপ, শকুনসহ অসংখ্য পাখি, সরীসৃপ বিলীন হয়ে গিয়েছে। এর অন্যতম কারণ ওই মানুষ আর মানুষ! একটি জেলা শহরের কেউ যদি চায়, ঘণ্টাখানেক নিরিবিলি নির্জনে কোথাও গিয়ে একটু সময় বসবে, তার কোনো উপায় নেই। সর্বত্র মানুষ। এখন কৃষি সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয় পেশা। কিন্তু বাংলাদেশে ওই পেশায় যুবসমাজকে যথেষ্ট টেনে আনা যাচ্ছে না। তার কারণ, যত জনসংখ্যা বাড়ছে তত জমি মূল্যবান হয়ে উঠছে এবং সেই জমি চলে যাচ্ছে আবাস ও শহরায়নে। সেখানে নগদ লাভের বিষয় আছে। কৃষিতে সম্পৃক্ত শিক্ষিত যে দু-চারজনকে টেলিভিশনে দেখানো হয়, পত্রিকায় ফিচার করা হয়, তারা বিচ্ছিন্ন। সংবাদমাধ্যমেরও তো অনেক সংবাদ দরকার, তাই তারা ফিচার আকারের সংবাদ হয়ে আসেন।
সরকার সীমিত সামর্থ্যের মধ্য দিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। কিন্তু সে উন্নয়নের ফল ভোগ করতে কষ্ট হচ্ছে। ফ্লাইওভারের ওপর ট্রাফিক জ্যাম! সড়ক প্রশস্ত হচ্ছে, কিন্তু সেই প্রশস্ত সড়কে নামছে বহুগুণ যানবাহন। এরও কারণ দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। আগামী দশ বছর পর আমরা কোথায় জায়গা দেব বর্ধিত জনসংখ্যার?
আরও বিপজ্জনক কথা হলো, এই জনসংখ্যা থেকে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো শিক্ষার নামে, শিক্ষাবৃত্তির নামে পদ্ধতিগতভাবে কিছু মানুষ বের করে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা জনসংখ্যার খুব সামান্য অংশ হলেও মেধা চলে যাচ্ছে। সেই মেধাশ্রম কাজে লাগছে ওই সব উন্নত দেশের। আমরা যে প্রতি বছর লাখ লাখ জিপিএ ৫ উৎপাদন করছি তা শুধু বেকারত্ব, কর্মহীনতার ভলিউম বড় করছে। সুতরাং পোপের কথায় আমরা যেন উৎসাহিত না হই। পোপের কথা ইউরোপ বা জাপানের জন্য। আমাদের দেশে জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা এখন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক