রামজি বারউদ
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৩, ১১:৪৪ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন প্রজন্মই ফিলিস্তিনের হাল ধরবে

নতুন প্রজন্মই ফিলিস্তিনের হাল ধরবে

অতি সম্প্রতি জেনিনে ইসরায়েলের ভয়াবহ আক্রমণ কোনো আশ্চর্যজনক ঘটনা নয়। এ ছাড়া আরও বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, ১২ জন ফিলিস্তিনি হত্যা, ১২০ জনকে আহত করা এবং শরণার্থী শিবিরের প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়িঘর ও অবকাঠামোর ধ্বংস। তবে এসব হতাহত বা ধ্বংসে মূলত তেমন কোনো ফারাক তৈরি করে না। এমনকি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অবশ্যই জানেন জেনিনে সন্ত্রাসীদের ছিটমহলের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ধ্বংস করার উচ্চপ্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তার দেওয়া বক্তব্য বৃথা প্রমাণিত হবে। যখন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জেনিনে বাড়িঘর ধ্বংস করছিল, গাড়ি ভাঙচুর করছিল, তখন বেশ কয়েকটি প্রতিশোধমূলক হামলার খবর পাওয়া যায়। এসব হামলা করে ফিলিস্তিনিরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে গত সপ্তাহের মঙ্গলবার তেল আবিবে এবং এর দুদিন পর কেদুমিমের অবৈধ বসতিতে। প্রকৃতপক্ষে, ২০০০ সালের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার প্রতি ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে চরম সহিংসতা দুর্বল না হয়ে বরং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণ আরও বাড়িয়ে দেবে। তখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু তারপর অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ফিলিস্তিনি জনসাধারণ রাস্তায় নেমে আসে। একটি রূঢ় সত্য হচ্ছে, পিএর কোনো উদ্দেশ্যসাধনের শক্তি আসলেই নেই। প্রকৃতপক্ষে যখন পিএর কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদল জেনিনের সঙ্গে সংহতি পোষণ করতে এবং অঞ্চলটি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার প্রতিশ্রুতি দিতে যায়, তখন জেনিনের বাসিন্দারা তাদের শিবির থেকে সেই কর্মকর্তাদের বিতাড়ন করে। এভাবেই ইসরায়েল জেনিনের ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক দল পিএ নিজেকেও জনগণের ত্রাণকর্তা হিসেবে নতুনভাবে উদ্ভাবন করতেও সফল হয়নি। সুতরাং, এসব ঘটনা ঘটার পেছনে আসলে যুক্তিগুলো কী ছিল? হারেটজে লেখা, বিশ্লেষক জভি ব্যারেল পুরো জেনিন অপারেশনকে হাউস অ্যান্ড গার্ডেন থেকে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। তিনি আরও বলেন, পুরো দেশে এটি একটি নেহাত লোকদেখানো অভিযান ছিল। তিনি আরও লিখেছেন, শুধু জেনিনে নয়, পশ্চিম তীরের যে কোনো জায়গায় সেনাবাহিনী বা শিনবেট সুরক্ষা সেবার কোনো বিবেকবান ব্যক্তি, এমনকি ডানপন্থি বলয়গুলোতে জানাশোনা কেউই প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস করেনি যে, ইসরায়েলের এ অপারেশনটি ফিলিস্তিনের সশস্ত্র প্রতিরোধকে নির্মূল করবে। প্রকৃতপক্ষে, এটি একটি লোকদেখানো অভিযানই ছিল এবং এর প্রমাণ হলো সরকারি ইসরায়েলের নির্গত ভাষা, যার মধ্যে নেতানিয়াহু নিজেই নেতৃত্ব দেন। রাজনৈতিকভাবে এবং আইনগতভাবে বিবদমান ডানপন্থি ইসরায়েলি নেতা তার সেনাবাহিনীর ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়ে বড়াই করে বলেছিলেন যে, এ অপারেশন চালানো হচ্ছে খুব কৌশলগতভাবে—স্থল থেকে আকাশপথে এবং অবশ্যই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। তিনি জেনিনকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। যদি কখনো জেনিনে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ফিরে আসে, তিনি জেনিনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন এবং এটি জনকল্পনার চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে এবং অনেক বেশি শক্তিশালী উপায়ে ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে। তেল আবিবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টও এ চিত্তাকর্ষক অভিযানের সাফল্যের রেকর্ড করার সময় জেনিনে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ওপর ভারী আঘাত মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর সফলতার কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু এ উদ্দীপিত ভাষার কোনোটিই সত্য নয়। জেনিনে ইসরায়েল যাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে, তা আসলে সশস্ত্র প্রতিরোধের অনেক বড় ঘটমান বিষয়ের ক্ষুদ্র একটি অংশ, যেটি জনপ্রিয় প্রতিরোধের আরও বৃহত্তর আন্দোলনের ফলাফল। এটি অধিকৃত অঞ্চলের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে সবাই অনুভব করে। মনে রাখতে হবে যে, কোনো বিদ্রোহ দমন করা আসলে কোনো অগ্নিশক্তির প্রশ্ন নয়। অন্যদিকে, ইসরায়েলের চিত্তাকর্ষক এ অভিযানের কৃতিত্ব শুধু জ্বলন্ত আগুনে ইন্ধন ঢেলে দেওয়ার মতো হয়েছে। এতে করে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের বিবদমান চরম সহিংসতা কোনোভাবে দুর্বল হবে না। বরং এতে করে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণ আরও বেড়ে যাবে। বর্তমান সময়ে নেতানিয়াহু সবচেয়ে বড় বোকামি করেছেন। তিনি চাইছেন তার ক্রমবর্ধমান সমস্যাগুলো থেকে পাশ কাটিয়ে যেতে এবং তার কট্টর-ডান রাজনীতিবিদদের জোট ও তাদের অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের জনপ্রিয় ভিত্তিকে খুশি রাখতে। তাই তিনি হয়তো তার অজান্তেই ফিলিস্তিনে একটি সম্ভাব্য সশস্ত্র বিদ্রোহকে একটি আসন্ন পশ্চিম তীরে বিস্তৃত বিপ্লবে পরিণত করেছেন। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার বিপরীতে, ইসরায়েল বা পিএর নতুন প্রজন্মের ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকারীদের ওপর কোনো উদ্দেশ্য সাধনের উপায় নেই। তারা কোনো রাষ্ট্র, চাকরি বা আন্তর্জাতিক তহবিলের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় না। তারা আটক, নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুর হুমকিও ভয় পায় না। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল যত বেশি সহিংসতা চালায়, স্বাভাবিকভাবেই তারা এর বিপরীতে তত বেশি সাহসী হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ এই নতুন ফিলিস্তিনি প্রজন্মের রাজনৈতিক বক্তৃতার যে কোনো পরীক্ষাই এমন নির্ভীকতা প্রদর্শন করে, যা সত্যি নজিরবিহীন। এ সাহসিকতার জন্য গাজাকে আরোপিত করা যেতে পারে, যার চলমান প্রতিরোধ গত দুই দশক ধরে অবরোধ এবং ভয়াবহ যুদ্ধ সত্ত্বেও পশ্চিম তীরের যুবসমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। যখন পিএর প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এবং তার ফিলিস্তিনি শত্রুরা জাতীয় ঐক্য আলোচনা ও ক্ষমতা ভাগাভাগির দীর্ঘ ছন্দে লিপ্ত ছিল, তখন নতুন প্রজন্ম এ ভাসা ভাসা এবং কপট স্লোগানের স্রোত থেকে বিপরীতমুখে এসে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে যাচ্ছিল। যদিও ১৯৯০-এর দশকে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের পরই তাদের বেশিরভাগের জন্ম বা পরিপক্বতা অর্জন, তারা সেই যুগের রাজনৈতিক ভাষা এবং সংস্কৃতিকে বিজাতীয় বলে উপলব্ধি করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখন ফিলিস্তিন দুটি—একটি হচ্ছে আব্বাস, ফাতাহ, বিভিন্ন উপদল, অসলো ও দাতাদের অর্থ, ‘শান্তি প্রক্রিয়া’ এবং নোংরা রাজনীতি। আর আরেকটি ফিলিস্তিন হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের, ‘সুমুদ’ (অটলতা), গাজা, জেনিন, নাবলুস, লায়নস ডেন এবং আরও অনেক অঞ্চল ও ঐতিহাসিক ঘটনা। নেতানিয়াহু, গ্যালান্ট বা আব্বাস এবং তার পিএ মিত্ররা কেউই রাজনৈতিক বক্তৃতা, সংস্কৃতি ও ভাষার এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন বুঝতে ইচ্ছুক নন। তারা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে অনাগ্রহী। কারণ, এটি বিদ্যমান ব্যবস্থার উদ্দেশ্যগুলো পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। আবার নেতানিয়াহু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান যতদিন সম্ভব। অন্যদিকে গ্যালান্ট দেখাতে চান সামরিক শক্তি। তার ইচ্ছে তিনি ভবিষ্যতে বড় কোনো পদে আসীন হবে। আর আব্বাস যা পাবেন (ক্ষমতা বা অর্থ) তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন। তবে সম্ভবত এ সমস্যার মূল অনেক গভীরে। অতীতে হয়তো এ সমস্যার সমাধান করা যেত, হয়তো বা সহিংসতা, পিএর সঙ্গে দুর্নীতি বা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে আগের পন্থাগুলো মূল্যহীন। তারা হয়তো সঠিক পথেই থাকবে। কারণ তারা দুর্বল, কোনো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নেই এবং ফিলিস্তিনে কী হচ্ছে সে ব্যাপারে তাদের স্বচ্ছ কোনো ধারণা নেই। এটি একটি প্রজন্মগত সমস্যা এবং একটি দ্বন্দ্ব। ইসরায়েল জেনিন আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘটনা এবং চরিত্র তার আগের রূপে ফেরত এসেছে। তারা দ্রুতবেগে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেছে এবং তাদের চির-অনুমানযোগ্য ভাষা ব্যবহার করে। সেগুলো হচ্ছে—অনুমোদন, নিন্দা, সাধুবাদ ও সতর্কতা। বর্তমান সময়ে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। পুরোনো প্রজন্মের জন্য সময়টা স্থির হয়ে গেছে। নতুন ফিলিস্তিনি প্রজন্ম অতীতকে কবর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন তারা নিজেদের পক্ষে কথা বলতে এবং নিজেদের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত। জেনিন দিয়েই তার সূচনা।

লেখক : বিশ বছরের বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লিখছেন। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন আমরিন খান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিকেলে ব্যাংকে ঢুকে লুকিয়ে ছিল সহিদুল, রাতে ডাকাতির চেষ্টা

সকালে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়? মেনে চলুন এই ৬ টিপস

মেসি ঝলকে ফাইনালে মায়ামি

চাঁদা না দেওয়ায় গণঅধিকার নেতার হাতে ইউপি চেয়ারম্যান লাঞ্ছিত

মাদকসেবন করে মাতলামি করায় যুবকের কারাদণ্ড

আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না: সুনীতা আহুজা 

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদমর্যাদাক্রম নিয়ে পরবর্তী আপিল শুনানি ৪ নভেম্বর 

শহিদের সঙ্গে প্রেম-বিচ্ছেদের কারণ জানালেন কারিনা

গাজায় তীব্র রূপ ধারণ করেছে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মৃত্যু ৩১৩ জনের

রাজধানীতে লরির ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল সিএনজি, নিহত ১

১০

টিয়া পাখি নিয়ে ভিডিও করে বিপাকে শিক্ষিকা 

১১

গ্রিন কার্ডের আবেদনে আসছে বড় পরিবর্তন

১২

কেমন থাকবে আজকের ঢাকার আবহাওয়া

১৩

গাজাবাসীর জন্য রোজা থাকছেন বিশ্বের ১৫০ আলেম

১৪

ডেনমার্ক দূতাবাসে চাকরির সুযোগ

১৫

সকালে উঠেই কোন ভুলের কারণে বাড়ছে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি 

১৬

গাজা সিটির নতুন এলাকায় ট্যাংক নিয়ে ঢুকেছে ইসরায়েলিরা

১৭

বেড়েছে স্বর্ণের দাম, আজ ভরিতে বিক্রি হচ্ছে কত টাকায়

১৮

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতায় কতটা অস্বস্তিতে ভারত?

১৯

সারা দেশে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ১৬৬২

২০
X