বাজেট নিয়ে মানুষ এখন আর আগের মতো ভয় পায় না। আগের সেই দিন বাঘে খেয়ে ফেলেছে। একটা সময় পর্যন্ত বাজেট ঘোষণার আগের সময়টা খুব তটস্থ থাকত বিভিন্ন মহল। ভয় হতো, কোন জিনিসের দাম কত বাড়ে। এখন তারা সব আগেভাগেই জেনে যায়। দাম যা বাড়ানোর ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই বাড়িয়ে ফেলেন। এবার আগেই ফাঁস হয়েছে, সৎ পথে আয়ের ওপর সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ বাড়বে, আর অসৎ পথে আয় করা কালো টাকা সাদা করতে মাত্র ১৫ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় এ দর্শন ও ন্যায্যতা বুঝতে এখন আর মস্ত অর্থনীতিক হওয়া লাগে না। কারওয়ান বাজার-শ্যামবাজারের আড়তদার নয়—এ অর্থনীতি বোঝার ওস্তাদ হয়ে গেছে ফুটপাতের ফেরিওয়ালারাও।
সব অপ্রদর্শিত অর্থ কালো টাকা নয়, সততা ও বৈধভাবে অর্জিত অর্থও আইনের ফেরে বা অপব্যবহারে কালো হয়ে যায়। সারা দুনিয়াতেও এসব অর্থকে এই সুযোগ দিয়েই মূল অর্থনীতিতে আনা হয়। আমাদের এখানে আইনত তারা ‘কালা মানিক’ই থাকছে। আবার এটাই ভোগবাদী ও ধনবাদী অর্থনীতির দর্শন। পুঁজি অর্থনীতির প্রথম জেনারেশনকে দ্রুত পুঁজি আ্যকুমুলেট করার জন্য নানা কায়দায় সুবিধা দেওয়া হয়। লুটপাট করেই হোক কিংবা যেভাবেই হোক পুঁজি জোগাড় করো, শোষণ যে মাত্রায় করা যায়, করো। চোরকে আরও চুরি করা, আর সৎ লোককে আরও অসৎ হতে উৎসাহিত করা হয়। আকবর আলি খান সেই কবেই এই অর্থনীতিকে ‘শুয়োরের বাচ্চা’দের অর্থনীতি বলে গেছেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদে বাজেট পেশ মানে ‘সবকিছুই প্রস্তাব আকারে সংসদে উত্থাপন’, অতঃপর তার ওপর সংসদে আলোচনা করে চূড়ান্ত করার পর তা আনুষ্ঠানিক অনুমোদন। অর্থাৎ প্রস্তাব মানেই অনুমোদন নয়; চাকরির দরখাস্ত দেওয়া মানেই চাকরি হয়ে যাওয়া নয়—আবার কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া মানেও তার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়া নয়। অথচ মোবাইলের নয়া কলরেট নাকি সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কণ্ঠে প্রস্তাব আকারে উচ্চারিত হওয়া মাত্রই কার্যকর! আকবর আলি খানের কথিত ওই ‘শুয়োরের বাচ্চা’রা আসলেই এখন বাঘের বাচ্চা।
বাজেটে অর্থনীতির জটিল-কঠিন অনেক টার্ম ব্যবহার করা হয়। যথারীতি এবারও হয়েছে। সোজা করে স্বীকার করা হয় না, বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে তিন গরিবের শ্রমের ওপর। গ্রামের গরিব কৃষক, পোশাক কারখানায় কাজ করা তার কিশোরী কন্যা আর ঋণ করে এবং জমি বেচে বিদেশে যাওয়া তার ছেলেটার পাঠানো অর্থের ওপর। অথচ এই শ্রেণি সবচেয়ে বঞ্চনার শিকার।
সরকারের আর পরিবারের বাজেট মোটেই এক স্বভাবের নয়। এ দুই বাজেট তৈরির তরিকা ও পন্থা ভিন্ন। পারিবারিক বাজেট দাঁড় করানো হয় সম্ভাব্য আয়দৃষ্টে। আর রাষ্ট্রের বাজেট তৈরি হয় সম্ভাব্য ব্যয় হিসাব করে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয় হিসাব করে রাজস্ব আয়ের টার্গেট ঠিক করে সরকার। আবার এ কথাও তো সত্য, আয় আছে বলেই তো ব্যয়ের এত হিম্মত মানুষের। আয় বেড়েছে বলেই বেশি খরচ করছে মানুষ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুততার সঙ্গে সমৃদ্ধি অর্জন করছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৬৭৬ টাকা। এই হিসাবে একজন মানুষের দৈনিক আয় ছিল ১ টাকা ৮৫ পয়সা। এর পর থেকে মাথাপিছু আয় কখনো কমেনি। মাথাপিছু আয় বাড়তে বাড়তে ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৪০ টাকায় উঠেছে। ফলে এখন প্রতিজন দৈনিক ৪৪০ টাকা আয় করে। ফলে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আড়াইশ গুণ বেড়েছে মাথাপিছু আয়।
অর্থনীতির ব্যাখ্যা একটি জটিল সমীকরণ। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দ্রব্যের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। বহুবার টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। অবশ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট কথা, মানুষের সচ্ছলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিনির্ভর এ দেশটিতে রয়েছে এক বিশাল জনসমষ্টি। রয়েছে খাদ্য ঘাটতি। দেশে নেই তেমন কোনো শিল্পায়ন, নেই কোনো খনিজ পদার্থ। আমদানিনির্ভর দেশ থেকে কোনো রপ্তানি সুবিধা নেই। চা, পাট, চামড়া, চিংড়ি রপ্তানি তলানিতে চলে গেছে অনেক আগেই। বস্ত্র শিল্প শিকায় উঠে উঠে ভাব। রেমিট্যান্সযোদ্ধারা বিভিন্ন দেশে দাবড়ানিতে কাহিল। তার পরও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। টিকে আছি। আয় করছি। টাকা রপ্তানি করছি সুইস ব্যাংকসহ দেশে-দেশে।
বাংলাদেশ জন্মেছে বাংলাদেশের মতো। টিকে আছে নিজের মতো। এর প্রতিটি অর্জনেও রয়েছে নিজস্বতা। অর্থনীতি বা সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক নিয়মনীতি আর বিধান এখানে তেমন খাটছে না। আবার বাংলাদেশের একেকটি অঘটনেও তা-ই, যা বিশ্ববাস্তবতায় মেলে না। নজির পাওয়া যায় না। করোনার বৈশ্বিক বিপর্যয়ে কাবু বাংলাদেশও। শিক্ষা, শিল্পকারখানাসহ চারদিক বিপর্যস্ত। তার ওপর প্রাকৃতিক-সামাজিক বেহাল দশা। এর মাঝেও ঘুরে দাঁড়ানো চরিত্রের ছাপ। অন্যভাবে বলা যায়—এটাই বাংলাদেশ।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন