ধারে নেই, কাছে নেই, তবুও প্রতিদিনই প্রাসঙ্গিক তারেক রহমান। আর সেটা নিয়মিত করে ছাড়ছে সরকারপক্ষই। অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রতিদিনই গালমন্দ তাকে। মানসিক-শারীরিক নাস্তানাবুদ হয়ে তারেক দেশান্তরী প্রায় দেড় যুগ। এ সময়টা বিএনপি তাকে ততবার স্মরণ করেনি, যা করে চলছেন ক্ষমতাসীন সরকার, দল, নেতা-মন্ত্রীরা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন লন্ডনে থেকেই। দল চালাচ্ছেনও সেখান থেকে। আদালতের ব্যতিক্রমী নির্দেশনায় গণমাধ্যমে তার বক্তব্য বা সংবাদ প্রচার নিষিদ্ধ। কিন্তু মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের কয়েক নেতা তারেকের বক্তব্য ও সংবাদ প্রচারের সেই কাজটি করে যাচ্ছেন। তারেকের নাম উচ্চারণ ছাড়া তাদের বক্তব্যই জমে না।
আলোচিত আজিজ-বেনজীর-মতিউর নিয়ে বলতে গেলেও তারা তারেকের নাম উচ্চারণ ছাড়া বক্তব্য দিতে পারছেন না। নইলে অসমাপ্ত থেকে যায় তাদের বক্তব্য। তা মানুষকে ভালো রকমের বিনোদন দেয়। এর মধ্যে আবার কদিন পরপরই তারেককে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আনার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, তা সময়ের ব্যাপার মাত্র—এ ধরনের তথ্য দেন সরকারের হাইপ্রোফাইলরা। আবার বলেন, সাহস থাকলে তারেককে দেশে আসতে। তারেককে দল থেকে বাদ দিলে বিএনপি রাজনীতিতে ভালো করবে মর্মে পরামর্শও দিচ্ছেন। সরকারি দলের নেতাদের বিএনপির প্রতি এমন হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া দলটির চিকনবুদ্ধিওয়ালা নেতাকর্মীদের জন্য বেশ প্রণোদনার।
টানা এত বছর দেশান্তরী থাকা, আদালতের মাধ্যমে বক্তব্য প্রচার বন্ধ করাসহ কিছু বিষয়ে তারেক রহমান এরই মধ্যে একটি উদাহরণ তৈরি হয়ে গেছেন। বছর নয়েক আগে বাংলাদেশের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তারেককে নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়। সেই প্রেক্ষাপটে ‘আইনের দৃষ্টিতে পলাতক’ থাকা অবস্থায় তার বক্তব্য বা বিবৃতি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে আবার তারেক রহমানের সাম্প্রতিক সব বক্তব্য অনলাইন থেকে সরানোর জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত রুল শুনানির মধ্যে বাদীপক্ষের এক সম্পূরক আবেদনে আসে আদেশটি।
এসব আদেশ-নির্দেশে তারেকের প্রচার বন্ধ থাকছে না। যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন ফরম্যাটে তার যাবতীয় সংবাদ আরও বেশি প্রচার হচ্ছে। নিষিদ্ধ জিনিসে কেবল ছোটদের নয়, বড়দের আকর্ষণও এখন বাড়বাড়ন্ত। মানুষ খতিয়ে খতিয়ে তা দেখে। এই বাজার বুঝে বিএনপির ক্ষতিগ্রস্ত নেতাদের সহায়তায় ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ নামে নতুন সেল গঠন করেছে বিএনপি। নবগঠিত এ সেলের দায়িত্বে রয়েছেন দলটির দুজন উপদেষ্টা। তারা হলেন ইঞ্জিনিয়ার মো. আশরাফ উদ্দিন ও আলমগীর কবীর। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের নোটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে গুম, খুন ও পঙ্গুত্বের শিকার বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশে থাকার প্রত্যয়ে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ নামে সেল গঠন করা হয়েছে।
দেশে বা ধারেকাছে না থাকার পরও প্রতিদিনই তাকে নিয়ে এত উৎসাহের বিপরীতে বিরক্তি প্রকাশ ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয়েও তাকে প্রাসঙ্গিক করার জায়গা থেকে সরার অবস্থা এখন আর সরকারের নেই। হঠাৎ তা বন্ধ করে দিলে দাঁড়াবে আরেক অর্থ। সরকার রাজনীতিতে নির্ভার। কোনো টেনশন নেই। বিএনপি মাঝেমধ্যে একটু-আধটু আওয়াজ দিলেও শক্ত কোনো কর্মসূচি দিতে পারছে না। এরপরও তারেককে নিয়ে কৃত্রিম ঝড় বইয়ে দেওয়া হচ্ছে। তা দুই তরফা। পুলকের জেরে বিএনপি বলে বসছে, তারেকের ভয়ে সরকারের ভিত নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। এর জবাবে দেরি না করে সরকার ও আওয়ামী লীগ থেকে তারেকের দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচারের কথা রিমেক করা শুরু হয়। লন্ডনে বসে তারেকের জন্য এটি বিনোদন ও স্বস্তির। সরকারেরও জানা, তারেক রহমান লন্ডনে শুয়ে-বসে কাটাচ্ছেন না, শুধু বিএনপির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণই করছেন না, আরও নানান কিছু নড়াচড়া করছেন। দেশের বিভিন্ন দলের রাজনীতিকের বাইরে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীসহ অনেকে তার সাক্ষাতে যাচ্ছেন। যখনই হোক তারেক রহমান রাজনীতিতে ফিরলে আওয়ামী লীগকে অনেক মাশুল দিতে হবে। বিএনপির কারও কারও ভাগ্য বিপর্যয়ও হবে।
ওয়ান ইলেভেনের দুঃসহ স্মৃতি এবং নানা প্রচার-অপপ্রচার অবশ্যই তাকে তাড়া করে। সেই তাড়নার শোধ তিনি কীভাবে নেবেন তা একান্তই তার ব্যাপার। ভীতিতে ভাইপারের বিপরীতে একটি হাইপার চলছে। এ বাস্তবতায় বিএনপির তারেকবিদ্বেষী গ্রুপটিও তার বন্দনায় শামিল হয়ে গেছে। আর তাকে নিয়ে ভয়ের বার্তা সরকারি মহল নিয়মিতই দিয়ে যাচ্ছে। এমন একটা সন্ধিক্ষণে পুরোনো কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে বিএনপির ভেতরে-বাইরে জল্পনা-কল্পনা চলছে। ক্ষুব্ধ সিনিয়র নেতাদের কারও কারও দাবি, নতুন গৃহীত উদ্যোগ নিয়ে দলের কোথায় কী আলোচনা হয়েছে, তারা জানেন না। স্থায়ী কমিটিতে সাধারণ আলোচনা হয়ে থাকতে পারে, সেটা আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে কিছু বলেন না। ১৫ জুন ঈদের এক দিন আগে দলের বিদেশবিষয়ক কমিটি ভেঙে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই প্রধান হয়েছেন—সে নিয়েও ব্যাপক আলোচনা চললেও কোনো পর্যায় থেকে কেউ মুখ খুলছেন না। নেতারা বলছেন, ঘোষণার আগে এ নিয়েও ন্যূনতম ইঙ্গিত ছিল না। ফলে কেন এ ধরনের রদবদল হলো তা বোঝা যাচ্ছে না। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে রদবদল এসেছে। ৩৯ জন নেতাকে দলের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাদের প্রায় সবাই দলের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিএনপির বিদেশবিষয়ক দুটি কমিটি গঠনও একটি ঘটনা।
বিএনপিতে চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের বর্তমান বিদেশবিষয়ক কমিটি ভেঙে দিয়ে দুটি কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। এর মধ্যে চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই। এই কমিটিতে বিগত কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে চার নম্বরে রাখা হয়েছে। আগের কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে কমিটিতে রাখা হয়নি। এর নেপথ্যও বেশ গভীরে। সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে পদস্থ কর্মকর্তাদের একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারির খবর ভাইরালের মতো ছড়াচ্ছে। দেশে এখন একই সঙ্গে ঘটনার এত ঘনঘটা যে, কোনটা মূল ঘটনা আর ছদ্ম ঘটনা, তা বোঝা দুষ্কর। এর মধ্যেই চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার নিয়ে যে তুলকালাম তা রোখাও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। ভয় ও আতঙ্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, রাসেলস ভাইপার হোক আর অন্য কোনো সাপ হোক, দেদার পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। সাপ বা মানুষ বা যে কোনো কিছু নিয়ে আনন্দ, ভয়, আতঙ্কের প্রতিক্রিয়া আখেরে কখনোই ভালো ফল দেয় না।
পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের কয়েকজনের বিপুল সম্পদের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর, পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রীরা বিবৃতি দিয়ে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের দায় কেন পুলিশের সংগঠন কিংবা মন্ত্রীরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। দেশে এই যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, তার মূল দায় অবশ্যই রাজনীতিবিদদের। ক্ষমতার জন্য এখন জনগণ আর ম্যাটার করে না, ম্যাটার করে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও ব্যবসায়ীদের অভিজাত অংশ। ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে তাদের লেনদেন ও পরস্পরকে রক্ষার বিনিময়ে গড়ে ওঠা নেক্সাসের কঠিন সময়ে তারেক ফোবিয়া, হাইপার বা উচ্চাশার একটা জেরও এখানে প্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশের সাংঘর্ষিক রাজনীতির সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীনরা চায় আজীবন গদিনশিন থাকতে। এ ক্ষেত্রে যারা ম্যাটার করেন তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। যে কারণে বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে ব্যবসায়ী, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, পুলিশসহ বিভিন্ন মহলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ক্ষমতাপাগল রাজনীতির অন্যান্য অংশীজনও তা করেন। ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ীদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাতেই দায়মুক্তির সংস্কৃতি। তা শুধু দলে দলে নয়, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিতেও হয়ে এসেছে। ৯ বছর ক্ষমতার পাগলা ঘোড়া দাবড়ানোর পর পতিত এরশাদকে নিয়ে দলে দলে, জনে জনে তা হয়েছে উচ্চমার্গে। ১৬-১৭ বছরের দেশান্তরী তারেক রহমান কি জেনারেল এরশাদের চেয়ে খুব বেশি বা একবারে ভিন্ন কিছু? বিচ্ছিন্ন কিছু খবর তো মাঝেমধ্যে নানা সোর্সে ফাঁস হচ্ছেই। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ বা যোগাযোগের অভিযোগে কয়েক আমলা-পুলিশের চাকরি গেছে। নামকরা কয়েক ব্যবসায়ীকে মাশুলও দিতে হয়েছে। এই শাস্তিতে তা বন্ধ হয়ে গেছে বা এখনো কারও সঙ্গে হচ্ছে না—তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? ঈদের দাপাদাপির মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিএনপির অভ্যন্তরীণ অ্যাকশন এবং ঈদের পূর্বাপর দলের বাইরের কারও কারও লন্ডন সফরের খবর সেই নিশ্চয়তা দেয় না। বরং বাড়তি বার্তা দেয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন