দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির পর বিদেশে তার উন্নত চিকিৎসাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি—এই তিন দেশ বিবেচনায় রয়েছে দলটির। তবে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে কোন দেশে নেওয়া হবে, বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দল, চিকিৎসক ও পারিবারিক সিদ্ধান্তে দ্রুততম সময়ে তা পরিষ্কার হতে পারে।
তবে খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ড ও বিএনপির একটি সূত্র বলছে, খালেদা জিয়াকে কোন দেশে নেওয়া হবে, তা মূলত তার শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে। এই মুহূর্তে টানা ১০-১৫ ঘণ্টা ভ্রমণ করার মতো অবস্থা তার নেই। এদিক থেকে আকাশপথে স্বল্প দূরত্ব বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে তাকে সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ডেও নেওয়া হতে পারে। সেখানে শারীরিক অবস্থার উন্নতি সাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে পরে আমেরিকা ও ইউরোপের ওই দুই দেশের যে কোনো একটিতে নেওয়া হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দিতে পারে দল ও তার পরিবার। কারণ, গত বছরের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাংলাদেশে এসে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার যকৃতে ‘ট্র্যান্সজাগুলার ইন্ট্রাহেপেটিক পোরটোসিসটেমিক শান্ট (টিপস)’ সম্পন্ন করেন।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ম্যাডামের বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো দেশের সঙ্গে এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি। তাকে পরবর্তী ফলোআপের জন্য আগের মতো আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মানির কোনো ভালো সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার জন্য মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ আছে।’
এদিকে চিকিৎসার দেশ এখনো চূড়ান্ত না হলেও খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত সোমবার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাকে স্থায়ী মুক্তি দেওয়া হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমানের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া গত মঙ্গলবার পাসপোর্টও হাতে পেয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ওইদিন দুপুরে দ্রুতগতিতে তার পাসপোর্ট নবায়নের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরে চিকিৎসাধীন বিএনপি নেত্রীর পক্ষে তার প্রতিনিধির কাছে নবায়নকৃত মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) হস্তান্তর করা হয়। তাকে সাধারণ নাগরিকদের ব্যবহৃত সবুজ রঙের পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে। বিএনপি এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, এর আগে ২০২১ সালের জুনে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া গতি পেলে তার পাসপোর্ট নবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তড়িঘড়ি পুরোনো পাসপোর্ট নবায়ন করে ডেলিভারির জন্য রেডি করে
পাসপোর্ট অধিদপ্তর। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে শেষ পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে খালেদা জিয়ার হাতে পাসপোর্ট না দেওয়ার নির্দেশনা আসে। এমনকি পরে তার নবায়নকৃত পাসপোর্ট বাতিলও করা হয়।
৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসের পাশাপাশি ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ছাড়াও হৃদরোগ, ফুসফুস, কিডনিসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা এর আগে একাধিকবার জানিয়েছেন, বিদেশে উন্নত মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে নিয়ে লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া খালেদা জিয়া পুরোপুরি সুস্থ হবেন না। শুধু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির বিশেষায়িত হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব। গত তিন বছরে পরিবারের সদস্যরা উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে কয়েক দফা অনুমতি চাইলেও সাময়িক মুক্তির শর্তের যুক্তি দেখিয়ে প্রতিবারই তা নাকচ করেছে সরকার।
দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান। যদিও বিএনপির দাবি, মিথ্যা মামলায় তাকে অন্যায়ভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনে তাকে নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া এবং দেশের বাইরে না যাওয়ার শর্তে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়। তার সেই সাময়িক মুক্তির মেয়াদ প্রতি ছয় মাস পরপর বাড়ানো হচ্ছে। এমন অবস্থায় গত মঙ্গলবার বঙ্গভবনের এক প্রজ্ঞাপনে খালেদা জিয়াকে স্থায়ী মুক্তি দেওয়া হয়।