সদ্য গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জন্য বিদ্যুৎ খাতের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও আয়-ব্যয় হিসেবের একটি সার সংক্ষেপ তৈরি করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এতে উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমানে পিডিবির দেনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সর্বশেষ আর্থিক মূল্যায়নে দেনার এই পরিমাণ উঠে আসে। পাশাপাশি এই দেনা বিদ্যুৎ খাতে মারাত্মক আর্থিক চাপ তৈরির কথাও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা সময় দিলে চলতি সপ্তাহে বিদ্যুৎ খাতের সংক্ষিপ্তসার উপস্থাপন করা হবে। এখানে উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় নিজ দায়িত্বে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি পিডিবির কাছে অনেক টাকা পায়। এটা বর্তমান সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে। কারণ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি রয়েছে। ভর্তুকির টাকা ছাড় না করায় দিন দিন দেনা বেড়েছে। এ ছাড়া বকেয়া টাকার অধিকাংশই পরিশোধ করতে হবে ডলারে। বর্তমানে ডলার সংকটও একটা বড় বিষয়। তারা বলছেন, অল্প অল্প করে হলেও দেনা পরিশোধ করা প্রয়োজন। তা না হলে কোম্পানিগুলো উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারে। এতে আরও বড় সংকট তৈরি হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের সব চুক্তি পুনর্মূল্যায়নেরও দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়; কিন্তু কেউ এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে চাননি।
জানা গেছে, সার সংক্ষেপে পিডিবির দেনার হিসাব করেছে ডলারের সরকারি দাম ও খোলা বাজারের দাম দুভাবেই। সরকারি হিসাবে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১১৭ টাকা ধরে ৩ দশমিক ৮৪৬ বিলিয়ন এবং খোলা বাজারের ১২৪ টাকা ধরে ৪ দশমিক ৩৫৪ বিলিয়ন ডলার হয় দেনা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) ও ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের সব বিল ডলারের পরিশোধে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ ক্রয়ের বিল টাকায় পরিশোধ করা গেলে দেনার চাপ কিছুটা কমত। কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ খাতের বিল পরিশোধে দৈনিক ৪০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৫ থেকে ৭ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, দেনা তো পরিশোধ করতে হবে। যা হয়ে গেছে তা ক্লিয়ার করা উচিত। এখন দেনা পরিশোধ না করলে, উৎপাদকরা যদি উৎপাদন বন্ধ করে দেয় তাহলে ব্যাপক অসুবিধা হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যত চুক্তি হয়েছে, তা পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। প্রয়োজন হলে একটা ট্রুথ কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
এর আগে গত মে মাসে বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পিডিবির কাছে বিভিন্ন সংস্থার পাওনা ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে আইপিপি ও রেন্টাল ফার্নেস অয়েল, গ্যাস ও সৌর বিদ্যুতের কেন্দ্রগুলোর বিল বকেয়া ১৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। কয়লাভিত্তিক বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বিল বকেয়া ৬ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ভারতের আদানির বিল বকেয়া ৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল বকেয়া রয়েছে ১ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের বাইরে বিভিন্ন সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলও বকেয়া পড়েছে। এর পরিমাণ ৯ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর বাইরে পেট্রোবাংলার আওতাধীন বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানির কাছ থেকে কেনা পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের বিল বকেয়া ৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিডিবিকে প্রতি মাসে বিল পরিশোধ করতে হয় গড়ে ৮ হাজার ৭০০ কোটি থেকে ৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তবে গড়ে রাজস্ব আয় ৫ হাজার ১০০ কোটি থেকে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আয়-ব্যয়ের এই হিসাবে প্রতি মাসে ঘাটতি থাকছে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে ১০ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর পরও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রাপ্য ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৯১২ কোটি টাকা।