ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় কাউন্সিলর আর নেতাদের কবজায় ছিল ময়লা বাণিজ্য। বর্জ্য সংগ্রহে পিসিএসপি (প্রাথমিক বর্জ্য সংগ্রহকারী সেবা প্রতিষ্ঠান) নিবন্ধন বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামে থাকলেও তারা ছিলেন মূলত কাউন্সিলরদের ঘনিষ্ঠ। তাদের দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করলেও নির্দিষ্ট ভাতা ছাড়া ময়লার লাভের গুড় যেত কাউন্সিলরদেরই পকেটে। তবে সরকার পতনের পর ময়লার ব্যবসার নিয়ন্ত্রকও পরিবর্তন হয়েছে। এবার দখল নিয়েছেন বিএনপির নেতারা। করপোরেশনে লটারির মাধ্যমে নিবন্ধন পাওয়া ৫১টি ওয়ার্ডের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশই বিএনপি নেতাদের নামে। বাকি ২৪টি ওয়ার্ডের নিবন্ধন দিতে করপোরেশনে লটারির আয়োজন থাকলেও বিএনপি নেতাদের বাধায় ১৩টি ওয়ার্ডে আর লটারি করতে পারেনি করপোরেশন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৩১ জুলাই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পিসিএসপি নিবন্ধনের সময়সীমা ছিল। এর আগে ডিএসসিসির নতুন নিবন্ধনের আবেদন জমা পড়লেও পরিবর্তিত সরকার এলে সেটি বাতিল করে গত ১৫ আগস্ট আবার বিজ্ঞপ্তি দেয়। গত ৫ সেপ্টেম্বর করপোরেশনে লটারির মাধ্যমে ৫১টি ওয়ার্ডে পিসিএসপি নিবন্ধন চূড়ান্ত হয়। বাকি ২৪টি ওয়ার্ডে একটি করে আবেদন পড়লে আবার বিজ্ঞপ্তি দেয় করপোরেশন। এ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগের ২৪টি ওয়ার্ডের বিপরীতে ১৯টি এবং পরবর্তী সময়ে ৮০টি, মোট ৯৯টি আবেদনপত্র দাখিল করা হয়। এর মধ্যে ৬৯, ৭০, ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো আবেদনপত্র জমা পড়েনি। ফলে এ তিনটি ওয়ার্ডে ফের দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। আর ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে আগের আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়। বাকি ২০টি ওয়ার্ডে দাখিলকৃত আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই শেষে লটারির মাধ্যমে নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত হলেও বাদ সাধেন বিএনপি নেতারা।
সিটি করপোরেশনের যাচাই-বাছাইয়ে নিজস্ব ভ্যান, আগের ময়লা সংগ্রহের অভিজ্ঞতাসহ নানা শর্তে বাদ দেওয়া প্রতিষ্ঠানকে রেখে দিতে চান বিএনপি নেতারা। এর জন্য তারা বর্জ্য কর্মকর্তাকে নিজ কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন। বাধ্য হয়ে ১, ২, ৪, ১৪, ২১, ২২ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে ছাড়া বাকি ১৩টি ওয়ার্ডে আর লটারি করতে পারেনি করপোরেশন।
অভিযোগ আছে, সূত্রাপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহ্বায়ক মেহেদী হাসান লিটু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের নেতা সৈয়দ মুকিতুল হাসান রঞ্জু, সাবেক ছাত্রদল নেতা ও ডিএসসিসির এক প্রকৌশলী বর্জ্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পিসিএসপি নিবন্ধনে আবেদনকারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে গত ৫ সেপ্টেম্বরে ৫১টি পিসিএসপি নিবন্ধনের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই বিএনপির নেতাদের। আর যে ওয়ার্ড বিএনপি নেতারা ছাড়া অন্য কেউ পেয়েছেন, তারা বর্জ্য উত্তোলন করতে পারছেন না। জানা যায়, ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডে ২০২৩-২৪ সালে বর্জ্য সংগ্রহের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ‘শ্যামপুর যুব উন্নয়ন সমিতি’। প্রতিষ্ঠানটির নার্গিস আক্তার বর্তমান কাউন্সিলর শফিকুর রহমান সাইজুর ঘনিষ্ঠ। গত ৯ বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও তিনি লটারির মাধ্যমে নিবন্ধন পান। কিন্তু বিএনপি নেতা মো. মনজু মিয়ার বাধায় নার্গিসের প্রতিষ্ঠান বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। এমনকি গত জুলাই ও আগস্ট মাসের বিলও তুলেছেন মনজু মিয়া। এ নিয়ে নার্গিস আক্তার সিটি করপোরেশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি।
শুধু এই ওয়ার্ডের নয়, ডিএসসিসির সব ওয়ার্ডে একই চিত্র। সরকার পতনের পর ময়লা বাণিজ্য অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিএনপি নেতাদের পকেটে। অনুসন্ধানে কয়েকটি ওয়ার্ডে পিসিএসপি নিবন্ধনের প্রতিষ্ঠানে দেখা গেছে, ডিএসসিসি এলাকার ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ করছে মেসার্স শাহাদাত স্টিল, যার মালিক ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শুভ শিকদার। ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছে গেন্ডারিয়া থানা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান ফরিদীর মারিয়াম এন্টারপ্রাইজ। ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির সহসভাপতি নুরুজ্জামান বাবুর সোহেল এন্টারপ্রাইজ, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছে ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির নেতা শাহ জাহানের প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডে ইজারা পেয়েছে আলম অ্যান্ড কোং। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহ আলম হলেও ঠিকাদারি কাজটি পেয়েছেন ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী। ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড পেয়েছে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মোছলেহ উদ্দীনের স্বাধীন এন্টারপ্রাইজ। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে পেয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা সফিউদ্দিন আহমেদ সেন্টুর এসএএস এন্টারপ্রাইজ।
৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইজারাদার বিএনপি নেতা শাহ জাহান কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতি করার কারণে গত সাড়ে ১৫ বছর সিটি করপোরেশনে কোনো কাজ করতে পারিনি। জেল-জুলুমের শিকার হয়েছি। আমার লাইসেন্সে ৬ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের নেতারা শিডিউল কিনেছিলেন। তারা লটারিতে কাজ পেয়েছেন। ময়লার ঠিকাদারি কাজে সাধারণত দলীয় নেতাকর্মীরা সহযোগিতা করেন।’
ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবু তাহের কালবেলাকে বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে পিসিএসপি নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম ঘটেনি। আর আবেদন জমা পড়লে যাচাই-বাছাই করে বাদ দেওয়া হয়েছে।’
সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বিল কমেনি: নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় পরিবারপ্রতি ময়লার বিল মাসে ১০০ টাকা নেওয়ার কথা। আর ছোট দোকানে থেকে প্রতি মাসে ৩০ টাকা করে নেওয়ার কথা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের প্রভাব খাটিয়ে বাড়তি টাকা আদায় করা হতো। নতুন ইজারাদার এলেও সেটি আর কমেনি। ধানমন্ডি, লালবাগ, পরিবাগ, ইস্কাটন ও মতিঝিলসহ বেশকিছু এলাকায় ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। হোটেলগুলো থেকে ৫০০ থেকে শুরু করে সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
ডিএসসিসি এলাকায় ৪৫৮ কোটি টাকার ময়লা বাণিজ্য: শুধু ঢাকার দক্ষিণ অংশে বছরে ময়লার বিল হয় ৫০১ কোটি টাকা। ঢাকার এ অংশে হোল্ডিং রয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৮৯৫টি। একেকটি ভবন গড়ে পাঁচতলা হলে ২৫ লাখ ১৮ হাজার ৯৫০ পরিবার বসবাস করে। প্রতি পরিবারের ময়লার বিল গড়ে ১৫০ টাকা করে ধরা হলে প্রতি মাসে ময়লার বিল আসে ৩৭ কোটি ৭৮ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা। বছরে এ পরিমাণ ৪৫৩ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব মতে, ঢাকার দক্ষিণ অংশে প্রায় ৪ হাজার রেস্টুরেন্ট আছে। প্রতি মাসে ৪০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ময়লার বিল নেওয়া হচ্ছে রেস্টুরেন্ট থেকে। অনেক রেস্টুরেন্ট থেকে দৈনিক ৫০ থেকে ১০০ টাকাও নেওয়া হয়। যদি রেস্টুরেন্টগুলোর ময়লার বিল গড়ে ১ হাজার টাকা ধরা হয়, তবে মাসে আসে ৪০ লাখ আসে। প্রতি বছর যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বাদ দিলেও ডিএসসিসি এলাকায় ময়লা বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে ৪৫৮ কোটি টাকারও বেশি।