নরসিংদী আঞ্চলিক সমবায় প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (উপনিবন্ধক) অধ্যক্ষ আশরাফুল ইসলাম। স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম হিরুর মদদে দীর্ঘ ১১ বছর নরসিংদী সমবায় অঙ্গনে গড়ে তুলেছেন প্রতারণা, লুটপাটের সাম্রাজ্য। কোটি টাকা চুক্তিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কটন মিলস নির্বাচন; ৯০ দিনে ৪৩ লাখ টাকার খরচ দেখিয়ে সমিতির কোষাগার করেন শূন্য। কর্মকর্তাদের নামে ভুয়া প্রশিক্ষণ দেখিয়ে সরকারি লাখ টাকা আত্মসাৎ, ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় দোকান বিক্রি করে জমা দেন মাত্র দেড় লাখ। ট্রেনিং সেন্টারকে কমিউনিটি সেন্টার বানিয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এভাবে তিনি কোটি কোটি টাকা কামালেও স্থানীয় এমপির সঙ্গে সখ্য থাকায় থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অভিযোগ আছে, নরসিংদীর জেলা সমবায় কর্মকর্তা হিসেবে সোনার বাংলা কটন মিলস সমবায় সমিতির মামলা পরিচালনার নাম করে স্থানীয় এমপির মদদে সাধারণ দোকানিদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা উত্তোলন করেন। অভিযোগ আছে, স্থানীয় এমপির লোকজন সোনার বাংলা মার্কেট থেকে চাঁদা আদায় করতেন। কেউ চাঁদা না দিলে দোকানে তালা ঝুলিয়ে দিতেন। এমপির লোকজন কোনো কারণে চাঁদা নিতে দেরি করলে এ টাকা তুলে রাখতেন আশরাফুল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আশরাফুলের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন। এর আগে সমবায় অধিদপ্তরে অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০২১ সালের আগস্টে সাবেক সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যকে ‘ম্যানেজ’ করে অন্তর্বর্তী কমিটির সাবেক সভাপতি এডিসি জেনারেলকে সরিয়ে কমিটির দায়িত্ব নেন আশরাফুল। এরপর নানা অনিয়ম করে সমিতির অর্থ আত্মসাৎ করেন। অন্তর্বর্তী কমিটির মূল কাজ ছিল প্রকৃত সদস্যের সমন্বয়ে ভোটার তালিকা তৈরি করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। তা না করে সমিতির অর্থ ব্যয় করে উন্নয়নকাজ করেন আশরাফুল। সমবায় সমিতি আইনের ধারা-১৮(৫) অনুযায়ী অন্তর্বর্তী কমিটি কোনো ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে না। কিন্তু উন্নয়নের নামে সমিতির সঞ্চিত অর্থ আত্মসাতের ফন্দি করেন আশরাফুল ইসলাম।
সমিতির রেজ্যুলেশন ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২২ সালের ৩ এপ্রিল সমিতির নির্বাচন। কিন্তু এ বছর মার্চের ১২ তারিখে রেজ্যুলেশনে রাস্তা পাকা করা, কলাপসিবল গেট নির্মাণ, সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ভবনের রং করা ইত্যাদি কাজের কথা উল্লেখ করে ভুয়া ভাউচার তৈরি করেন অধ্যক্ষ আশরাফুল। এরপর ছয় দিনের মাথায় ৮ লাখ টাকার ভাউচার পাস করান। এপ্রিলের ৩ তারিখে নির্বাচনে যাতায়াত বাবদ ৩৯১ জনের নামে ৫ হাজার টাকা করে ভুয়া স্বাক্ষর ও ভুয়া বিল করে প্রায় ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন।
অধ্যক্ষ হিসেবে আশরাফুল ইসলাম যখন দায়িত্ব নেন, সমিতির কোষাগারে ৩০ লাখ ৪১ হাজার টাকা ছিল। সমিতির আয়সহ প্রায় ৪৩ লাখ টাকা ভুয়া ভাউচার করে তুলে নেন তিনি। সমিতির আইনের বাইরে গিয়ে উন্নয়নকাজের নামে ৯০ দিনে সমিতির কোষাগার শূন্য করেন।
অভিযোগ আছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপির যোগসাজশে ১ কোটি টাকার বিনিময় একটি পক্ষকে নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ের গ্যারান্টি দিয়ে প্যাকেজ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন আশরাফুল। তৎকালীন বিভাগীয় যুগ্ম নিবন্ধক রিয়াজুল কবিরকে নির্বাচন কমিটির সভাপতি বানিয়ে এবং নিজে অন্তর্বর্তী কমিটির সভাপতি হয়ে সোনার বাংলা কটন মিলস লিমিটেডের নির্বাচন করান। নির্বাচিত কমিটির প্রত্যেক সদস্যের কাছ থেকে ১০ লাখ করে টাকা নেন আশরাফুল। ২৪টি দোকান নির্মাণ করে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করলেও মাত্র দেড় লাখ টাকা করে কোষাগারে জমা দেন তিনি।
একইভাবে সোনার বাংলা কটন মিলস সমবায় সমিতির নারায়ণগঞ্জ শাখার ক্যালেন্ডার মেশিন বিক্রি করে এবং একটি ট্রাস্টকে দখলকৃত জায়গা ছেড়ে দিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এখান থেকে ১ কোটি টাকা দেওয়া হয় সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ছেলেকে।
অভিযোগে আছে, প্রশিক্ষণের নামে ভুয়া হাজিরা সিট তৈরি করে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তিনটি প্রশিক্ষণ কোর্স দেখিয়ে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। জেলা অফিসের দুজন এমএলএসএসের কর্মচারী পদোন্নতির কথা বলে ঘুষ নেন। প্রশিক্ষণ সেন্টারকে কমিউনিটি সেন্টারে রূপ দিয়ে প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
তার এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সমবায় অধিদপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে। এ ছাড়া আশরাফুলের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন ভুক্তভোগী কয়েকজন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ আশরাফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘হ্যাঁ, এই রকম কিছু হয়েছে। স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী, পৌরসভার মেয়ররা এসব করছেন। তারা নির্দেশনা দিলে কাজ করতে হয়।’ উন্নয়নের নামে ৪৩ লাখ টাকার ভাউচার দেখিয়ে আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় উন্নয়ন করা যাবে না, এই কথা কোথাও উল্লেখ নেই।’ কোটি টাকার বিনিময়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য হলো ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে ঠিকই; কিন্তু টাকা নেওয়ার কথা মিথ্যা। যারাই এসব বলছে, তারা মিথ্যা বলছে।’ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহানারা খাতুন কালবেলাকে বলেন, ‘আশরাফুল ইসলামের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করা হবে। প্রমাণ পেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
এ বিষয়ে কথা বলতে সমবায় অধিদপ্তর মহাপরিচালক মো. শরিফুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।