ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ‘ফ্যাসিস্ট’ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সামনে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা সূচনা হবে বলে অনেকে স্বপ্ন দেখেছিলেন। যেখানে জবর-দখল, হানাহানি, দলীয় কোন্দল, প্রতিহিংসা থাকবে না। বিগত সরকারের অত্যাচার, নিপীড়ন, গণ-মামলার সংস্কৃতি আর নতুন করে ফিরে আসবে না; কিন্তু সময় যত যাচ্ছে বিদ্যমান দলগুলোর কিছু নেতাকর্মী নিজেকে আত্মশুদ্ধি না করে অপরাজনীতির পুরোনো চর্চার মধ্যেই রয়ে গেছেন। নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। এমন কাণ্ডে দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে হারাতে হচ্ছে দীর্ঘদিনের অর্জিত পদপদবিও। তার পরও থেমে নেই তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পুরোনো দ্বন্দ্ব আছে—এমন ব্যক্তিদের জড়ানো হচ্ছে ছাত্র-জনতা হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায়। আবার নাম কাটিয়ে চলছে বাণিজ্য। তথ্যমতে, গণঅভ্যুত্থানের পর চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) বিভিন্ন থানায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক ৪৯টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে কোতোয়ালি থানায় ১৩টি, সদরঘাট থানায় একটি, বাকলিয়া থানায় তিনটি, খুলশী থানায় দুটি, চান্দগাঁও থানায় ১০টি, পাঁচলাইশ থানায় ১১টি, ডবলমুরিং থানায় ৮টি ও হালিশহর থানায় একটি।
নগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ কালবেলাকে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালীন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৪৯টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৯টি হত্যা মামলা। মামলায় ৫ হাজার ৩৬৭ জন এজাহারনামীয় আসামি রয়েছেন। অজ্ঞাত আসামি রয়েছে ৯ হাজার ৬৬০ জন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৪৩ জনকে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান।
সাফওয়ান নামে একজন শিক্ষার্থীর অভিমত, দেশ সংস্কার ও পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারকে দেশ ছাড়া করেছে এ দেশের ছাত্র-জনতা। হরিলুট, দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি বন্ধসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, প্রতিটি সেক্টরে বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি নিয়ে ৩৬ জুলাইয়ে আন্দোলন করেছিল ছাত্র-জনতা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনের পর ৫ আগস্ট আরেকবার স্বাধীন হয়েছে এই দেশ। কিন্তু এতেও বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। মামলায় নাম কাটিয়ে আবার বাণিজ্য চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য নেতাদের হুকুম বা পরামর্শ পালন করছেন কি না, সেটিও খোঁজ নিতে হবে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আরও কিছু ঘটনা চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গত ২ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরীতে আধিপত্য বিস্তারের জেরে মারধরের শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাস্তুহারা ইউনিট কমিটির বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও ২৭নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা নূর আলম। গত ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন জিয়াকে দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি এক প্রকৌশলীর জায়গা জোর করে দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে বিজয় মেলা নিয়ে বিরোধে বিএনপির দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ১১ জন।
এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান কালবেলাকে বলেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অতীতে অনেকের জায়গা বেদখলসহ বেহাত হয়ে গিয়েছিল। অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আছে, অনেক দোকানদার আছে। হয়ত নিজেদের জিনিসগুলো নিজেরা ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, এ ধরনের আর কি। আবার দখলদাররা ফেলে গেছে এই ধরনের একটি বিষয় আছে।
তিনি বলেন, এর বাইরে যে দখল-বেদখলের ঘটনা নেই, তা ঠিক নয়। তবে তা খুবই কম। দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে আমরা কঠোর নির্দেশনা পেয়েছি। যার কারণে আমরা চেষ্টা করছি, ঘটনা যতই ছোট হোক, এগুলো থেকে তাদের নিবৃত্ত করব। এ জন্য আমরা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ছাড়া আমাদের দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের ওপরও দল কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল মো. নুরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, জামায়াত ইসলামী প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, জুলম ইত্যাদি রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। বিগত ১৫ বছর দলটির নেতাকর্মীরা নির্যাতন, জুলুম ও মামলার শিকার হয়েছিল। সরকারি চাকরিতে অনেক কর্মীদেরকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। আজ সেই মিথ্যাচারী, জুলুমবাজ, স্বৈরাচার সরকারকে এদেশের মানুষ চিরতরে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। জামায়াত ইনসাফের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডারবাজি, জুলুম ইত্যাদির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
তিনি আরও বলেন, বিগত ১৫ বছর জামায়াতের আদর্শ, সৌন্দর্য ইত্যাদি মিডিয়ার সামনে তুলে ধরার সুযোগ ছিল না। স্বৈরাচার সরকার দেশ থেকে পালানোর পর সেই সুযোগ এসেছে। আমাদের কাছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মের কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা জুলুমমুক্ত সরকার চাই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
ব্যবসায়ী আদনান কালবেলাকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছুতেই কাম্য নয়। অস্থিরতার আঁচড় বাজারে পড়লে তা নিত্যপণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। অতীতের মতো চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, বৈষম্য ইত্যাদির যাতে পুনারাবৃত্তি না হয় সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সিএনজি অটোরিকশাচালক তোফায়েল কালবেলাকে বলেন, আমরা দিনে আনি দিনে খাই। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া চাঁদাবাজমুক্ত সমাজ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো। অতীতে যারা সিন্ডিকেট করে বাজার অস্থিতিশীল করে রেখেছিল, তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, এখন আমরা কঠিন সময় পার করছি। শহর থেকে গ্রামে অরাজকতা আরও বেশি। গণমাধ্যমে চাঁদাবাজি, দলীয় কোন্দলে সংঘর্ষ, দখল, মামলার হুমকি, বাণিজ্য ইত্যাদির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসা দরকার। এদেশের ছাত্র-জনতা আন্দোলন করে এক জুলুমবাজকে তাড়িয়েছে। আর কোনো জুলুমবাজ ক্ষমতায় বসে যাবে, তা দেশের মানুষ মেনে নেবে না।