ঢাকা-চট্টগ্রাম ডিজেল পাইপলাইন বাণিজ্যিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত। এরই মধ্যে পরীক্ষামূলক পরিবহনের কাজ সফলভাবে শেষ হয়েছে। চলতি জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে এ পাইপলাইন দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ডিজেল পরিবহন শুরু হবে। দেশে প্রথমবারের মতো জ্বালানি তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহে বছরে আড়াইশ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিপিসি চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান কালবেলাকে বলেন, এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পাইপলাইনে পরীক্ষামূলকভাবে ৬ হাজার টন ডিজেল পরিবহন করা হয়েছে। পাইপলাইনটি বাণিজ্যিক অপারেশনে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে যে ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, তা আর হবে না। যেমন রেলওয়ের ওয়াগন থাকলেও লোকোমোটিভ পাওয়া যায় না। সড়কপথে পণ্য পরিবহনে যানজটসহ নানা সমস্যা হয়, দীর্ঘ সময় লাগে। জলপথেও সমস্যা হয়। পাইপলাইনটি চালু হলে এসব সমস্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল ৭০ শতাংশ। সেটা সরবরাহ নিশ্চিত হবে পাইপলাইনটি চালু হলে। পেট্রোল ও অকটেন আগে যেভাবে সরবরাহ করা হতো, কখনো রেলওয়ে ওয়াগনে করে, কখনো নদীপথে ট্যাঙ্কারে করে, সেভাবেই আসবে।
জানা গেছে, গত ২৪ জুন থেকে পাঁচ দিন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এ পাইপলাইনে মাধ্রমে ডিজেল নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষামূলক এ সরবরাহ শতভাগ সফল বলে বিপিসি কর্মকর্তারা জানান।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশ আমদানি করা হয়। বছরে দেশে জ্বালানি তেলের গড় চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫৯ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে ৩০ লাখ ৮০ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল জি-টু-জি চুক্তির আওতায় এবং ২৮ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা হয়। এর বাইরে ১৪ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিপিসি। পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল, মোগ্যাস, জেট এ-১, ফার্নেস অয়েল এবং মেরিন ফুয়েল রয়েছে। পরিশোধিত তেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় ডিজেল। দেশের ডিজেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ ব্যবহার হয় ঢাকায়। বর্তমানে ঢাকায় তেল পরিবহনের করতে প্রথমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নদীপথে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় তেল পরিবহন করা হয়। পরিবহনে ব্যবহৃত হয় প্রতি মাসে প্রায় ১৫০টি ছোট-বড় জাহাজ। এতে বছরে দুইশ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাইপলাইনটি চালু হলে সড়ক ও জলপথে পরিবহনের জন্য কোনো টাকা ব্যয় হবে না। শুধু পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ বিল, জমির ভাড়াসহ কিছু খাতে ব্যয় হবে ৯০ কোটি টাকা। বছরে প্রকল্পটি থেকে আয় হবে ৩২৬ কোটি টাকা। সাশ্রয় হবে আড়াইশ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে যে টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা আগামী ১৬ বছরের মধ্যে উঠে আসবে।
জানা গেছে, নদীপথে তেল পরিবহন কেন্দ্র করে একটি বিশাল সিন্ডিকেট বিদ্যমান। গোদনাইল ডিপো তেল চুরির জন্য স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত। সেই চুরিকে জায়েজ করতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো লাইটারেজ থেকে তেল খালাসের সময় অপচয় বলে। পাইপলাইন হয়ে গেলে সেই বিষয়টিও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছে বিপিসি।
শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৮৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। পরে সংশোধিত হয়ে বেড়ে ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকায়। এটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। সেনাবাহিনী ২৪ ব্রিগেড পাইপলাইন নির্মাণের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করায় এখন নারায়ণগঞ্জ (গোদনাইল ডিপো) থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত জেট ফুয়েল পরিবহনে পাইপলাইন নির্মাণের কাজও তাদের দেওয়া হবে বলে বিপিসির সূত্রে জানা গেছে। বিপিসির অর্থায়নে গৃহীত ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ২৩৭ কিলোমিটার।
মন্তব্য করুন