রাশেদ রাব্বি ও মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশাসন বদলায় তবু শাস্তি হয় না অপরাধীর

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশাসন বদলায় তবু শাস্তি হয় না অপরাধীর

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) ১৫ বছর আগে ২০১০ সালে অডিটর পদে নিয়োগ পান মো. আবদুল মতিন। ১১তম গ্রেডের পদে যোগ দিয়ে এক বছরের মাথায় নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনি ওই পদকে দশম গ্রেডে পরিবর্তন করেন। ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি আবারও পদোন্নতি পেয়ে নবম গ্রেডের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসারের দায়িত্বে বসেন। এরপর তিনি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। নিজের প্রয়োজন মেটাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের সই নিজে দিতেও দ্বিধা করতেন না মতিন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান রকফেলার ফাউন্ডেশনে বেতনভুক্ত হিসেবে কাজ করেছেন। বিগত ও বর্তমান প্রশাসনের সময়ে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এসব অভিযোগ একাধিকবার প্রমাণ হয়েছে, বারবার শাস্তির সুপারিশও করা হয়েছে। কিন্তু শাস্তি পেতে হয়নি তাকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর তার বিষয়টি সিন্ডিকেট সভায় দুবার উত্থাপিত হয়। আগের চেয়ে এবার শাস্তির মাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়। তবে স্বল্প শাস্তিও মতিনের কাছে পৌঁছাতে পারে না।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১০ সালের ৫ এপ্রিল মো. আবদুল মতিন বিএমইউর (তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) অডিটর হিসেবে ৬ হাজার ৪০০ থেকে ১৪ হাজার ২২৫ টাকা বেতন স্কেলে যোগ দেন। এক বছর অপেক্ষাধীন থাকার পর সন্তোষজনক কর্তব্য পালন সাপেক্ষে চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা বলা হয় নিয়োগপত্রে। এক বছর পর ২০১১ সালের ২৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় মতিন ১১তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে (দ্বিতীয় শ্রেণি) উন্নীত হন। এরপর ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার পদে (নবম গ্রেডে) উন্নীত হন তিনি। তবে এই পদোন্নতিগুলোর প্রক্রিয়া স্বাভাবিক ছিল না। নবম গ্রেডে উন্নীত হওয়ার পর মাত্র এক বছরেই বেরিয়ে আসে তার অনিয়মের তথ্য। ২০২১ সালের ৮ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশের ২-এর ঝ, ঞ, জ, ছ ধারা অনুযায়ী অবাধ্যতা, দুর্নীতিপরায়ণ, নৈতিকস্খলন এবং অসদাচরণের ধারায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়। অভিযোগগুলো হলো—কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই রকফেলার ফাউন্ডেশন প্রকল্পে নিযুক্ত হওয়া; নিজের ইচ্ছামতো অডিট সেলের ওভারটাইম গ্রহণ এবং একই সময়ে রকফেলার ফাউন্ডেশনে কাজ করে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ। এসব অনৈতিক কাজের বৈধতা দিতে তিনি নিজেই রকফেলার ফাউন্ডেশনের নথিতে তৎকালীন উপউপাচার্যের (প্রশাসন) স্বাক্ষর দেন। এমনকি ‘অনুমোদন করা যায়’ মন্তব্যও যুক্ত করেন। এসব অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সিন্ডিকেট সভায়। এতে বলা হয়, সতর্কীকরণ, তিরস্কার, এক বা একাধিক বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট স্থগিতকরণ, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দক্ষতা সীমা অতিক্রমের অনুমতি না দেওয়া, এক বা একাধিক বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করা। পদোন্নয়ন, উচ্চতর পদে নিয়োগ অথবা বেতন স্কেলে উন্নয়ন অথবা টাইম স্কেল কিংবা সিলেকশন গ্রেড নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত করা। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে উল্লিখিত নিয়মে আর্থিক জালিয়াতির টাকা প্রতি মাসে বেতন থেকে অথবা ভিন্ন পদ্ধতিতে আদায় করা; নিম্নতর স্তরে পদাবনতি, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ কিংবা চাকরিচ্যুতি। তার বিরুদ্ধে কেন এসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে না মর্মে সাত দিনের মধ্যে জবাব চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়।

এরপর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৫তম সিন্ডিকেট সভায় তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। তবে সেখানে পরিবারের কথা বিবেচনা করে আবদুল মতিনকে চাকরিচ্যুত না করে তার প্রতি নমনীয়তা দেখানো হয়; কিন্তু রকফেলার ফাউন্ডেশন থেকে নেওয়া অর্থ ফেরতের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়। একই সঙ্গে দুটি বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধের সুপারিশ করা হয়। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে আবদুল মতিনকে সতর্কীকরণ, রকফেলার ফাউন্ডেশন প্রকল্প থেকে ২০১৮ সালের পহেলা মে থেকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে নেওয়া অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে প্রদান; তৎকালীন পদ অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার থেকে পূর্ববর্তী ‘অডিট অফিসার’ পদে পদাবনতি করা হয়। এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি ২০২২ সালের ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপ-রেজিস্ট্রার মো. আব্দুল আলীমের সই করা পত্রের মাধ্যমে জানানো হয়।

এদিকে ২০২৪ সালে ১২ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ৯৪তম সিন্ডিকেট সভায় মো. আবদুল মতিনের জালিয়াতির বিষয়টি আবার উপস্থাপন করা হয়। সেখানে পদাবনতির শাস্তি বাদ দিয়ে লঘু শাস্তির প্রস্তাব এবং তাকে সতর্ক করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া রকফেলার ফাউন্ডেশনের প্রকল্প থেকে প্রতি মাসে নেওয়া টাকা ফেরতের এবং দুটির পরিবর্তে একটি ইনক্রিমেন্ট বন্ধের সুপারিশ করা হয়। এরপর আরও একটি পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে বিএমইউর বর্তমান প্রশাসন। সিন্ডিকেট সভায় এবার শাস্তি আরও কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় সতর্কীকরণ ও একটি ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করা; কিন্তু এরপর আট মাস অতিবাহিত হলেও সেই সুপারিশও কার্যকর হয়নি।

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে, এভাবে প্রমাণিত অপরাধীকে লঘু শাস্তি দেওয়া হলে কর্মকর্তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ বলেন, বিভিন্ন সময়ে যেসব চিকিৎসক ও নার্স এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী শৃঙ্খলা ভঙ্গের সঙ্গে জড়িয়েছেন, তাদের শাস্তি নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটি কাজ করছে। প্রথমে অভিযুক্ত চিকিৎসকদের শাস্তি নিশ্চিতে কাজ শুরু হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রম বিভিন্ন শ্রেণির স্টাফদের শাস্তি প্রদান করা হবে। আবদুল মতিনের বিষয়ে আমরা অবগত আছি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিআইডির ওপর হামলা, যুবক আটক

শুল্কের প্রভাব কমাতে এসি, চা ও স্কুল সরঞ্জামের দাম কমাচ্ছে ভারত

আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বপ্নের কথা জানালেন জামায়াত আমির

গুরুতর অভিযোগে আর্জেন্টিনাকে কোটি টাকার জরিমানা ফিফার

সুরমা নদীতে ভাসছিল জমিয়ত নেতার মরদেহ

ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত আফগানিস্তানে ত্রাণ পাঠাল বাংলাদেশ

পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যার পেছনে অস্ত্র হিসেবে পানি ব্যবহার করছে ভারত? 

অশ্লীল স্পর্শের শিকার অক্ষয় কুমার

শিশু তাসনুহার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার

‘ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলে কাদের জায়গা নিশ্চিত?’, উত্তর দিলেন আনচেলত্তি

১০

ডাকসু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন মাহিন

১১

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও ৩০ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হলো 

১২

ইঁদুরের কামড়ে হাসপাতালে প্রাণ গেল নবজাতকের

১৩

যে ৮ কারণে মুখের চামড়া কুঁচকে যায়

১৪

মোবাইল চার্জ দেওয়ার সঠিক সময় কখন?

১৫

বিয়ের ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের দায়ে যুবকের ২০ বছর কারাদণ্ড 

১৬

মুগ্ধতায় মিম

১৭

এক নজরে দেখে নিন এশিয়া কাপের ৮ দলের স্কোয়াড

১৮

এশিয়া কাপের জন্য বাংলাদেশের সেরা একাদশ বাছাই করলেন আকাশ চোপড়া

১৯

ফেসবুকে কোন সময়ে পোস্ট দিলে বেশি ভিউ পাওয়া যায়? যা বলছেন বিশেষজ্ঞ

২০
X