প্রাচীন বঙ্গ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র পুন্ড্রনগর—আজকের বগুড়ার মহাস্থানগড়। প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই স্থানে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পুরোনো নিদর্শন ও কিংবদন্তি। এর মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় এক স্থান ‘জিয়ৎ কুণ্ড’—একটি প্রাচীন কূপ, যা ঘিরে প্রচলিত আছে অলৌকিক নানা গল্প।
জিয়ৎ কুণ্ড মহাস্থানগড়ের শিবগঞ্জ উপজেলার করতোয়া নদীর কাছাকাছি অবস্থিত। ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, রাজা পরশুরামের শাসনামলে অর্থাৎ ১৮শ থেকে ১৯শ শতকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময় কূপটি খনন করা হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন, স্থানীয় মানুষের পানির অভাব দূর করতেই রাজা এ কূপ খনন করান।
প্রায় চার মিটার ব্যাসের এই কূপের গঠন বেশ অনন্য। উপরে চওড়া, নিচে সরু, ভেতরে রয়েছে গ্রানাইট পাথরের সজ্জা। উপরের অংশে বসানো আছে একটি চতুষ্কোণ পাথর, যা দিয়ে হয়তো প্রাচীনকালে পানি তোলা হতো।
কিন্তু কূপটির রহস্য শুধু স্থাপত্যে নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক জনশ্রুতি, যা মহাস্থানগড়ের ইতিহাসে এক অলৌকিক মাত্রা যোগ করেছে।
লোককথা অনুযায়ী, সেন রাজবংশের রাজা লক্ষণ সেনের সময় এই কূপের পানি মুখে দিলে মৃত সৈন্য বেঁচে উঠত, সুস্থ হয়ে উঠত আহত সৈন্য। কথিত এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী পরশুরামের সঙ্গে সংঘাতে জড়ান ইসলাম প্রচারক হজরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (রহ.)। বলা হয়, পরশুরামকে পরাস্ত করার জন্য শাহ সুলতান এক ঈগল পাখির সাহায্য নেন। ঈগলটি জিয়ৎ কুণ্ডে এক টুকরো গো-মাংস ফেলে দেয়, আর তখনই কূপটির ঐশ্বরিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এরপর যুদ্ধে পরশুরামের সৈন্যরা পরাজিত হয়, আর মহাস্থানগড়ে ইসলামী শাসনের সূচনা ঘটে।
মহাস্থানগড়ের স্থানীয় বাসিন্দা শামছুল আলম বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদারা বলতেন, আহত সৈন্যদের এই কূপের জলে ডুবিয়ে দিলে তারা সুস্থ হয়ে উঠত। আর মৃতরা বেঁচে উঠত। আমরা সেটাই বিশ্বাস করি।’
বগুড়ার ইতিহাসবিদ প্রয়াত আবদুর মান্নান তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘জিয়ৎ কুণ্ড নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলো হয়তো কিংবদন্তি, কিন্তু জনমানসে সেই বিশ্বাস এখনো জীবন্ত।’
মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘জিয়ৎ কুণ্ড প্রকৃতপক্ষে রাজা পরশুরামের সময়ের নিদর্শন। সম্ভবত পুন্ড্রনগরের মানুষের পানির চাহিদা মেটাতেই এটি খনন করা হয়েছিল।’
ইতিহাস, জনশ্রুতি আর রহস্য—সব মিলিয়ে জিয়ৎ কুণ্ড আজও পুন্ড্রনগরের এক নীরব সাক্ষী, যা সময়ের পরতে পরতে বয়ে নিয়ে চলেছে অতীত বাংলার কিংবদন্তি।
মন্তব্য করুন