বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ভ্যানিলা চাষ করে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছেন গবেষকরা। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি মসলা হিসেবে পরিচিত ভ্যানিলা বিন চাষে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ফল পাওয়া গেছে। বর্তমানে এই চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, এই সাফল্যের ফলে বাংলাদেশে কৃত্রিম ভ্যানিলা এসেন্স আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে এবং ভবিষ্যতে বিদেশে রপ্তানির নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হবে। গবেষকরা এখন এ জাত কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন।
জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে দামি মসলা ভ্যানিলার আদি আবাস মেক্সিকোতে। তবে বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া প্রায় ৫৮ শতাংশ ভ্যানিলা উৎপাদন ও রপ্তানি করে থাকে। ভ্যানিলা মূলত একটি অর্কিডজাতীয় লতানো উদ্ভিদ, যার বৈজ্ঞানিক নাম ভ্যানিলা প্লানিফোলিয়া। ভ্যানিলার গাছটি দেখতে গাঢ় সবুজ বর্ণের হলেও ফুলটির রং সাধারণত হলুদ রঙের। এটি মূলত এক ধরনের ফল, যা বরবটি বা শিমের মতো দেখতে। আর সেই ফলের বীজ থেকেই তৈরি হয় সুগন্ধি ভ্যানিলা ফ্লেভার। এই ফ্লেভার শুধু খাবারে নয়, কসমেটিকস ও পারফিউম শিল্পেও ব্যবহৃত হয়। এতদিন বাংলাদেশ পুরোপুরি বিদেশি ভ্যানিলা ও কৃত্রিম এসেন্স আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। আমদানি নির্ভর এই ভ্যানিলা এখন বাংলাদেশে চাষ করা সম্ভব।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু হেনা ফয়সাল ফাহিম ২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে ভ্যানিলার কাটিং চারা এনে দেশে পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করেন। তিন বছর পর গাছে ফুল আসে এবং হাতে পরাগায়নের মাধ্যমে সফলভাবে ফলও পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি গাছে একাধিক থোকায় ১৩ থেকে ১৫টি করে ফুল ধরে, যেগুলো ১৩ দিনের মধ্যে হাতে পরাগায়ন করতে হয়। সাত থেকে নয় মাসের মধ্যে ফল পরিপক্ব হয় এবং দেড় মাস ধরে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর তৈরি হয় ভ্যানিলা বিন। বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি ভ্যানিলা বিনের দাম ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
গবেষক ফাহিম জানান, পাঁচ থেকে ছয় ধরনের ভিন্ন লাইন নিয়ে তিনি কাজ করছেন। এর মধ্যে ভারতের একটি লাইন ও ইন্দোনেশিয়ার একটি লাইনে সফলভাবে ফল ধরেছে। তবে ভ্যানিলা চাষ খুবই শ্রমসাপেক্ষ। ফুল ফোটার পর প্রতিটি ফুলকে হাতে পরাগায়ন করতে হয় দুপুর ১২টার মধ্যে। এভাবে সফল পরাগায়নের পরই বিন পাওয়া সম্ভব। এরই মধ্যে ভ্যানিলা বিন থেকে এসেন্স তৈরির পরীক্ষাও সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি আরও জানান, প্রক্রিয়ায় বিনগুলোকে গরম পানির ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়, এরপর দুই মাস ধরে ধীরে ধীরে রোদে শুকানো হয়। শুকানোর পর ভ্যানিলা কালচে রং ধারণ করে এবং এর ভেতরের নরম অংশ থেকে তৈরি হয় প্রাকৃতিক এসেন্স। একটি বিন থেকেই পাওয়া যায় প্রায় এক টেবিলচামচ ভ্যানিলা এসেন্স। ভ্যানিলা গাছে ফল আসে মার্চ-এপ্রিলে, আর ফল পাকে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে। ফল পাকার পর এর ফ্লেভার বের করা হবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ভ্যানিলা চাষের জন্য বেশ উপযোগী বলে মনে করছেন গবেষকরা। পাহাড়ি এলাকা, ফলদ বাগান, উঁচু ভূমি কিংবা বাড়ির বড় গাছের ছায়ায়ও সহজে এই গাছ চাষ করা সম্ভব। তবে গবেষকরা বলছেন, ভ্যানিলা চাষের খবরে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ বেড়ে গেছে। তবে বাজারজাত ও সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের মাঝে চারা বিতরণ করা হবে না।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরই বিদেশ থেকে মসলা আমদানিতে গুণতে হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমদানিনির্ভরতা কমাতে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র এরই মধ্যে ২৪ প্রজাতির মসলার ওপর ৫০টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, হলুদ, ধনিয়া, কালিজিরা, মেথি, মৌরি ও দারুচিনির উন্নত জাত; যেগুলো এরই মধ্যে কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন এই ভ্যানিলা চাষের সাফল্য বাংলাদেশের মসলা উৎপাদনে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
মন্তব্য করুন