সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহুতল গাড়ি পার্কিংয়ের সামনে বিশালাকৃতির লাগেজ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকজন যুবক। একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কেউ কোনো কথা বলছিলেন না। একজন হাতে থাকা একটি সাধারণ ফিচার ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। কয়েকবার কোনো একটা নম্বরে কল করেও ওপাশ থেকে সাড়া পাচ্ছিলেন না। ওই যুবকদের একজন সুজন মিয়া, এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। গতকাল শনিবারই তার যাওয়ার কথা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাই। পরে সেখান থেকে আবার বাহরাইন। সে অনুযায়ী টিকিটও করা ছিল আমিরাত এয়ারলাইন্সে। শাহজালাল বিমানবন্দরের কর্গো ভিলেজে আগুন লাগার পর সেই ফ্লাইট স্থগিত হলেও সুজন জানতে পারছিলেন না, কাঙ্ক্ষিত ফ্লাইটটি কখন উড়বে। এতে যেন আকাশ ভেঙে পড়ে তার মাথায়।
দুবাইতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা সুজন ভেবে পাচ্ছিলেন না তার তখন কী করা উচিত। কারণ বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগায় দুপুর থেকেই সব ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণ ছিল বন্ধ। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর রাত ৯টায় বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণ শুরু হলেও তিনি জানেন না তার ফ্লাইট কখন।
সুজন মিয়া বলেন, ‘এখন কী দিয়ে কী হবে বুঝতেছি না। ফোনের সিম সঙ্গে না থাকায় বাড়িতেও যোগাযোগ করতে পারছি না। আবার কবে ফ্লাইট পাব সেটাও জানতে পারছি না। আমি যদি সময়মতো কাজে যেতে না পারি, তাহলে আমার কাজ থাকবে কী-না এটাও জানি না।’
সেখানে ছিলেন একই ফ্লাইটের যাত্রী চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার শ্যামল পাল, নোয়াখালীর রামগঞ্জের মো. কামালসহ আরও কয়েকজন। তারা কেউ বহুতল পার্কিংয়ের নিচতলায় বসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছিলেন, কেউবা আবার তাৎক্ষণিক করণীয় কী হতে পারে সেগুলো নিয়ে ভাবনায় মত্ত। তাদের কাছে বাংলাদেশের মুদ্রা না থাকায় দিনভরই না খেয়ে ছিলেন তারা।
বিমানবন্দরের দুই নম্বর টার্মিনালের চিত্র ছিল আরও ভয়াবহ। সেখানেও শত শত বিদেশগামীর স্বপ্নে লাগে আগুনের আঁচ। রাত ৮টায় গিয়ে দেখা যায়, মাথায়-হাতে বড় বড় সব ব্যাগেজ-লাগেজ নিয়ে ওই টার্মিনাল থেকে বের হচ্ছেন অনেকেই। সবারই বিদেশ যাওয়ার কথা থাকলেও যাত্রা স্থগিত হওয়ায় বিরসবদনে ফিরে যাচ্ছেন। এই যাত্রীদের বেশিরভাগই প্রবাসী শ্রমিক। তাদের মধ্যে একদলে ছিলেন নাজমুল সরকার, শম্ভু চন্দ্র মণ্ডলসহ চার থেকে পাঁচজন। এই দলের সবার গন্তব্য শ্রীলঙ্কা।
শম্ভু চন্দ্র মণ্ডল জানালেন, বিকেল সোয়া ৫টায় ইন্ডিগোর ফ্লাইটে তাদের শ্রীলঙ্কা যাওয়ার কথা ছিল। তারা সবাই নতুন শ্রমিক হিসেবে কাজে যাচ্ছিলেন দেশটিতে। ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় বেশ বিপাকে পড়েন।
অবশ্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আগুন নিয়ন্ত্রণের পর রাত ৯টা থেকে ফ্লাইট ওঠানামা শুরুর কথা জানায়। এর পর দুবাই থেকে আসা একটি ফ্লাইট নিরাপদে অবতরণ করে। তবে বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িক বন্ধ থাকার ঘোষণায় ততক্ষণে অনেক প্রবাসী ফিরে যান ঢাকায় স্বজনের বাসায়, কেউ কেউ ফোন নম্বর না থাকায় যোগাযোগও করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সে। আবার ফ্লাইট চালু হলে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষও যোগাযোগ করতে পারেনি এসব যাত্রীর সঙ্গে।
এদিকে ঢাকায় অবতরণ করার কথা থাকলেও বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নির্ধারিত ফ্লাইটগুলো চট্টগ্রাম ও সিলেটে অবতরণ করে। তাই দেশে ফেরা আপনজনদের পথ চেয়ে থাকা স্বজনদের অপেক্ষা যেন ফুরাচ্ছিল না। টার্মিনাল-২ এর আগমনী অংশে স্বজনদের অপেক্ষা ছিল চোখে পড়ার মতো। রেলিংয়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে থাকা কয়েকজন দুপুর থেকে তাদের কোনো এক স্বজন দেশে ফিরবেন এই অপেক্ষায় ছিলেন। বিকেল ৩টায় ফেরার কথা থাকলেও রাত ৮টা পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এমন একজন অপেক্ষমান স্বজন ফরহাদ আহমেদ। তার সঙ্গে ছিলেন পরিবারের অনেকেই। ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, ‘ভাই আসার কথা বিকেল ৩টায়; কিন্তু এখনো এসে পৌঁছায়নি। তার সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছি না।’
মন্তব্য করুন