সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২
রীতা ভৌমিক
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৩, ০৩:৪২ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পথশিশুদের ড্যান্ডি আসক্তি বাড়ছে

ঘ্রাণ থেকেই আসক্তি
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

ডিএমপি ঢাকা ট্রাফিক রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনের পান্থপথ ট্রাফিক পুলিশ বক্সের কোনাকুনি রাস্তার ডিভাইডারে বসে দুজন শিশু পলিথিনে মুখ ঢুকিয়ে ড্যান্ডি টানছিল। কয়েক হাত দূরে রাজধানীর ব্যস্তময় ফার্মগেট থেকে সায়েন্সল্যাবের দিকের রাস্তায় এবং কারওয়ান বাজার থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত যাওয়ার মাঝখানে পান্থপথ সিগন্যালের চৌরাস্তায় চারজন ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছিলেন। পথচারীরা নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন। সকালবেলা ব্যস্তময় রাস্তার ডিভাইডারের মাটিতে বসে এ দুই পথশিশু প্রকাশ্যে ড্যান্ডি টানছিল, তাতে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।

কারওয়ান বাজার চৌরাস্তায় সোনারগাঁও হোটেলের উল্টো দিকে ডিএমপি ঢাকার ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের সোনারগাঁও ট্রাফিক পুলিশ বক্স। এখান দিয়ে পলিথিনে ড্যান্ডি টানতে টানতে রাস্তা পার হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের পাশ দিয়ে কারওয়ান বাজারের দিকে যাচ্ছিল আকাশ নামে ১৪ বছরের এক শিশু। কারওয়ান বাজারে ঢুকতেই ওর সঙ্গী হয় আরেক ড্যান্ডি সেবক। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড বৃষ্টি নামে। দৌড়ে কারওয়ান বাজারে সবজি আড়তের সামনে ফুটপাতে এসে আশ্রয় নেয়। এখানে কথা হয় ওদের সঙ্গে। ময়মনসিংহের ফুলপুর থানার মেরিগাই গ্রাম থেকে ট্রেনে উঠে আকাশ। তেজগাঁও স্টেশনে এসে নামে। সবকিছুই অপরিচিত। কোথায় যাবে, কী খাবে, কিছুই জানে না।

আকাশ (ছদ্মনাম) বলল, ‘ঢাকায় আসছি কাজ করে নিজের জন্য একটা মোবাইল কিনব। আমরা তিন ভাইবোন। বাবা আরেকটা বিয়ে করে মাসহ আমাদের ফেলে চলে গেছে। ছোট ভাইটার বয়স দুই বছর। স্টেশনে ময়মনসিংহের ছোট্টবেলার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। ও ড্যান্ডি খায়। আমারেও খাইতে বলে। প্রতিদিন একটা কৌটা কিনি ১১০ টাকায়। দিনে দুইবার হইয়া যায়। কোরবানির গরুর গোশত টুকাইয়া তা বিক্রি কইর‌্যা যে টাকা পামু, তা দিয়া মোবাইল কিন্যা বাড়ি যামু।’

এসব খাচ্ছো, পুলিশ দেখলে ভয় লাগে না জিজ্ঞেস করতেই প্রতিউত্তরে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘পুলিশ কী বলব, আমি পুলিশের বাবা।’

কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেল, দেড় বছর থেকে ১৩-১৪ বছরের শিশুরা নিয়মিত ড্যান্ডি সেবন করে। তাদের সবার হাতেই ড্যান্ডি ভরা পলিথিনের প্যাকেট।

কারওয়ান বাজারের কয়েকজন আড়ত ব্যবসায়ী বলেন, মেয়েশিশুর তুলনায় ড্যান্ডি সেবনকারী ছেলেশিশুর সংখ্যা এখানে বেশি। আনুমানিক ৩০ থেকে ৪০ জন শিশু রয়েছে। ওরা চুরির ধান্ধায় থাকে। ধরা পড়লে পাবলিকের মারও খায়। ওদের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। ওরা এক জায়গায় স্থিত হয়ে থাকে না।

ফার্মগেট খামারবাড়ি মোড়ে দুটি পুলিশ বক্স, আরেকটি আনন্দ সিনেমা হলের কাছে ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের ফার্মগেট ট্রাফিক পুলিশ বক্স। আনন্দ সিনেমা হলের কাছে ফার্মগেট পুলিশ বক্সের সামনে ডিভাইডারে বসে ড্যান্ডি টানচ্ছিল ১০ বছরের মোহাম্মদ ইমরান। খালি গা, জীর্ণশীর্ণ শরীরে যেন বল নেই। রাজধানীর এ ব্যস্তময় জায়গাটিতে পথচারীরা বাস ধরতে ব্যস্ত। ওর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যেতেই উৎসুক চোখে তাকায়।

কেমন আছো জিজ্ঞেস করতেই একটু অবাক হয়। বাম হাতে ড্যান্ডির পলিথিন মুখে ধরে ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘২০টা টাকা দেন ভাত খামু।’

কথায় কথায় উঠে এলো, রাস্তায় বড় হয়েছে ও। বাবা-মা কে জানে না। ভাঙাড়ি টুকিয়ে তেজগাঁও রেলস্টেশনের সামনে বিক্রি করে। যখন যেখানে মন চায় চলে যায়। আলুপট্টি, লেবুপট্টি, এয়ারপোর্ট, কমলাপুর রেলস্টেশন।

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা কল্যাণপুর ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাত দিয়ে ড্যান্ডি টানতে টানতে হেঁটে যাচ্ছিল ১০-১১ বছরের দুই শিশু। তাদের একজনের নাম মোহাম্মদ জুবায়ের (ছদ্মনাম)। ময়মনসিংহ থেকে অবুঝ বয়সে বাবা-মার সঙ্গে ঢাকায় এসেছিল। কারওয়ান বাজারে ওদের দুই ভাইকে ফেলে রেখে চলে যায় বাবা-মা। বড় ভাই ভাঙাড়ি টুকিয়ে, নিজের খাবার জোগাড় করেছে, ওর খাবার জোগাড় করেছে। ওকে বড় করেছে।

এসব কেন খাও বলতেই জুবায়ের বলে, ‘একমুঠ ভাতের জন্য অনেক কষ্ট করছি। অনেক মানুষের মাইর খাইছি ভাই আর আমি। আমার বন্ধু বলছে, এটা খাইলে ক্ষুধা লাগে না। ওর কাছ থিক্যা খাওন শিখছি। ভাঙাড়ি টুকাইয়া বিক্রি কইর‌্যা হার্ডওয়্যারের দোকান থিক্যা ৮০ টাকায় কিনি। এইট্যা খাইতে খাইতে যেদিকে মন চায় চলতে থাকি। পুরা ঢাকা শহর ঘুইরা বেড়াই।’

গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের উল্টো দিকে ডিভাইডারে গোলাপ শাহ ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পেছনে বসে পলিথিনে মুখ দিয়ে ড্যান্ডি টানছিল ইয়াসিন নামে ১৫ বছরের এক শিশু। ওর মা মালিবাগ-মৌচাক মার্কেটে সুইপারের কাজ করেন। বড় বোন আছে। ছোটবেলায় একটা এনজিও স্কুলে শিশু শ্রেণিতে পড়েছে। স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লেখাপড়া আর এগোয়নি।

ইয়াসিন বলে, ‘বন্ধুগো ড্যান্ডি খাইতে দেইখ্যা আমিও খাওয়া শুরু করি। দিনে দুইবার খাই। এটা খাইলে খিদা লাগে না। মন চাইলে বাড়ি যাই। নইলে রাস্তায়ই থাকি।’

দয়াগঞ্জ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ বক্স, শান্তিনগর ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও নাগরিক সেবা কেন্দ্র, আগারগাঁও মোড়, মিরপুর-১ সনি সিনেমা হল মোড়, শ্যামলী স্কয়ারের সামনে, শিশুমেলা, দিলু রোডের মোড়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, মতিঝিল শাপলা চত্বর, কমলাপুর, শাহজাহানপুর, কাকরাইল মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, মালিবাগ মোড়, মগবাজার মোড়সহ বেশ কয়েকটি স্থানের ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পাশে শিশুদের ড্যান্ডি সেবনের দৃশ্য প্রায় একইরকম।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সূত্রে জানা যায়, ব্যস্তময় ঢাকা রাজধানীতে ট্রাফিক বক্স রয়েছে ১০৭টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪৫টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৬২টি। এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক বক্স রয়েছে। সব মিলিয়ে ঢাকায় ট্রাফিক বক্সের সংখ্যা দেড় শতাধিক হবে। এই ট্রাফিক বক্সের পাশে বসে বা এখান দিয়ে যাওয়ার সময় শিশুরা যেভাবে ড্যান্ডি সেবন করছে, ট্রাফিক পুলিশরা বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘শিশু আইনে মাদক মামলা না থাকায় এখানে পুলিশের কিছু করার নেই। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর যৌথভাবে এ পথশিশুদের ড্যান্ডি খাওয়া রোধে কাজ করতে পারে। ভবঘুরে কেন্দ্রে নিয়ে তাদের সংশোধনে ভূমিকা রাখতে পারে।’

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সুব্রত সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘শিশুদের ড্যান্ডি সেবন প্রতিরোধে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর টলরনির আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। টলরনি প্যাংকি থেকে শুরু করে অনেক কাজে লাগে। আবার টলরনি যদি বেশি নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে আঠাযুক্ত পণ্যের শূন্যতা তৈরি হবে। এ পথশিশুরা কেন ড্যান্ডি খায়, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ওদের সঙ্গে কথা বলে তা বের করে এনেছিলাম। ওরা বলেছিল, এটা খেলে ওদের নেশা হয় না। অর্থাৎ আসক্তি নয়, এটা খেলে ওদের অনেকক্ষণ খিদে লাগে না। পথশিশুরা রাস্তায় কাগজ, বিভিন্ন ধরনের জিনিস টোকায়। এসব বিক্রি করে বেশি টাকাপয়সা পায় না। অনেকক্ষণ যাতে খাবার না খেয়ে থাকা, অল্প খাবার খাওয়া, সারা দিনে একবার খেলেই হয়, এ জন্য ওরা ড্যান্ডি খায়। ওরা কিছুটা সময় হেলোসিনের মধ্যে থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রথমত এ গামগুলো যারা বিক্রি করছেন তাদের পথশিশুদের কাছে এটি বিক্রি না করার জন্য নিরুৎসাহিত করছি। ভ্রাম্যমাণ আদালতে এ পথশিশুদের বোঝানোর চেষ্টা করি ড্যান্ডি না খাওয়ার জন্য। ওদের বয়স কম, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে পথশিশুদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে। সরকারের যে সামর্থ্য তা দিয়ে এত পথশিশুর পুনর্বাসন, চিকিৎসা ব্যয় বহন করা অতটা সহজ নয়। এরপর শিশু পরিবার, কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে নিয়ে ওদের সংশোধন করা যেতে পারে। এ জন্য কিশোর সংশোধন কেন্দ্রের পরিধি বাড়াতে হবে।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. রকনুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের সার্বিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য পুলিশ রয়েছে। পুলিশের দায়িত্ব অনিয়ম, অনাচার প্রতিরোধে এ শিশুদের আইনের আওতায় আনা। পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া আমরা ড্যান্ডি সেবনকারী শিশুদের ধরতে পারব না। তাদের সহযোগিতায় এ শিশুদের মিরপুর আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে সংশোধন করা যেতে পারে।’

চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের প্রবেশন অফিসার মাসুদ রানার মতে, ‘পুলিশের সহায়তা ছাড়া এ শিশুদের সরকারি শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা যাবে না। আমাকে রিপোর্ট করলেই আমি এ শিশুদের শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে দিতে পারব। কারণ সরকারি শিশু আশ্রয়কেন্দ্রও শিশুকে রাখতে জিডি চায়। সমাজসেবা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এ কাজগুলো হয়ে থাকে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সোনারগাঁয়ে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন

মা ইলিশ রক্ষায় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার টহল

ন্যাশনাল পিপলস যুব পার্টির মাদকবিরোধী আলোচনা সভা

নিউমার্কেটে চুরির কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, নগদ টাকাসহ গ্রেপ্তার ১

আন্দোলনরত শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করায় ছাত্রশিবিরের নিন্দা

শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংকের বিবৃতি

কক্সবাজার আদালতে বিচারকের মোবাইল-মানিব্যাগ চুরি

পাঠ্যপুস্তক ছাপার দায়িত্ব হস্তান্তর ‘মাথাব্যথায় মাথা কাটার মতো সিদ্ধান্ত’ : টিআইবি

বিশ্বকাপে ইতিহাস গড়ে ভারতকে হারাল অস্ট্রেলিয়া

মৌসুমি বায়ুসহ আগামী ৪ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস

১০

চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা

১১

এবার উপদেষ্টাদের নিয়ে মুখ খুললেন সামান্তা শারমিন

১২

ঢাকায় আসছেন জাকির নায়েক

১৩

ছক্কা মেরে ইতিহাস গড়লেন স্মৃতি মান্ধানা!

১৪

উপদেষ্টা রিজওয়ানাকে এনসিপি নেতার হুঁশিয়ারি

১৫

একটি দল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় : কফিল উদ্দিন 

১৬

চাকসু নির্বাচনে নতুন প্রত্যয়ে ছাত্রদল

১৭

বন্দর ব্যবসায়ী নেতারা / মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধের ষড়যন্ত্রের অংশ

১৮

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নিয়ে ৬ হাজারের বেশি মতামত পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

১৯

জুলাইয়ের গাদ্দারদের সব রেকর্ড প্রকাশ করা হবে : মুনতাসির

২০
X