দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের পুত্রবধূ। তাই উৎসব আর বধূ বন্দনায় নতুন করে সেজেছে নগর। পথে-ঘাটে, মাঠে-প্রান্তরে সব জায়গায় এখন উৎসবের আমেজ। উৎসবের এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে বিভাগে। তবে বিভাগ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রংপুরে আসতে শুরু করেছেন দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।
আজ বিকেল ৩টায় নগর ও জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত রংপুর জিলা স্কুল মাঠের জনসভায় যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে ২৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ৫টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন তিনি।
এদিকে জনসভাস্থল রংপুর জিলা স্কুল মাঠে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সসহ (এসএসএফ) রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা কাজ করছেন সর্বোচ্চ সতর্কতায়। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় নৌকার আদলে তৈরি করা হয়েছে সভামঞ্চ। পাশেই মিডিয়া, মুক্তিযোদ্ধা ও অতিথি কর্নার। সামনে থাকবে জনতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা ঘিরে সব আয়োজন শেষ হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মাঠ পরিদর্শনে গেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে ওবায়দুল কাদের বলেন, শেখ হাসিনার আমলে দেশে যত উন্নয়ন হয়েছে, যত বিষোদ্গার ও প্রোপাগান্ডা করা হোক না কেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে ৭০ শতাংশ মানুষ নৌকায় ভোট দেবে। মানুষ উন্নয়নের পক্ষে ভোট দেবে।
প্রধানমন্ত্রীর সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে রংপুরের আনাচে-কানাচে ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যন্ত সাড়া জেগেছে। রংপুরে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ হবে। এর আগে সকাল ১১টার দিকে নগরীর আর কে রোডে বাংলাদেশ টেলিভিশনের আঞ্চলিক উপকেন্দ্র পরিদর্শনে যান তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পাঁচবার কানাডার আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পরও তাদের লজ্জা নেই। এবারও কানাডার আদালত বলেছেন, বিএনপি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাচ্ছে। তারা গাড়ি পোড়াচ্ছে, ভাঙচুর করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। সে কারণে তাদের দলের কাউকেই রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হবে না।
নগর পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিশেষ নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে পুরো নগরী। এক হাজারের বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। প্রবেশ রুটগুলোতে সন্দেহজনক যানবাহন ও ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে জনসভায় আসা-যাওয়া নির্বিঘ্ন করতে চান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। নেতাকর্মী ও সমর্থকদের গাড়ি পার্কিংয়ের নতুন রুট তৈরি করে দিয়েছে নগর ট্রাফিক পুলিশ।
সরেজমিন দেখা গেছে, মিছিলে মিছিলে একাকার নগরী। চলছে বর্ণিল প্রচারণা। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে পুরো নগরী। ধুয়ে-মুছে চকচকে করা হয়েছে রাস্তাঘাট, রোড ডিভাইডার। চলছে বাদ্যযন্ত্র ও গানের তালে নেচে-গেয়ে মাইকিং। জনসভাস্থল ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়, জিলা স্কুল মোড়, ডাকঘর মোড়, সুরভি উদ্যান মোড়, পুলিশ লাইনস মোড়, সিটি বাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মাইক টানানো হয়েছে। দফায় দফায় হচ্ছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা লীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর বর্ধিত সভা।
রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন বলেন, জনসভাকে ঘিরে আওয়ামী লীগ এখন ঐক্যবদ্ধ। রংপুরের সমাবেশে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও স্বেচ্ছাসেবক উপ-কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি। পাড়া-মহল্লায় উঠানবৈঠক থেকে শুরু করে সভা-সমাবেশ করা হয়েছে। পুরো বিভাগজুড়ে ব্যাপক গণসংযোগ চালানো হয়েছে। মানুষ এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত। তারা জনসভায় যোগ দিতে অপেক্ষা করছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন মণ্ডল মওলা বলেন, আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুকন্যা ও রংপুরের পুত্রবধূ শেখ হাসিনার আগমনে উচ্ছ্বসিত। লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে জিলা স্কুল মাঠে মানুষের ব্যাপক সমাগম ঘটবে, যা রংপুরের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান সিদ্দিকী রনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর রংপুর সফর এবং এই জনসভা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। আগামীতে রংপুর বিভাগের সব আসনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকার প্রতীকের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত হবে।
আওয়ামী লীগের রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, আমরা আশা করছি দলমত নির্বিশেষে এই জনসভায় সব শ্রেণির-পেশার মানুষ অংশ নেবেন।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন বলেন, জনসভাকে ঘিরে সব ধরনের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করেছি। ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা থাকবেন। পর্যাপ্তসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে এবং নগরীজুড়ে থাকবেন। সঙ্গে থাকবেন স্বেচ্ছাসেবকরা।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, জনসভায় ১০ লাখের বেশি মানুষ হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ রংপুরে এসেছিলেন ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর।
প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি: সফরসূচি অনুযায়ী, বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে রংপুরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। দুপুর ২টায় তাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি রংপুর ক্যান্টনমেন্টের হেলিপ্যাডে অবতরণ করবে।
দুপুর সোয়া ২টার দিকে সার্কিট হাউসে পৌঁছে বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এরপর বিকেল ৩টায় রংপুর জিলা স্কুল মাঠে মহাসমাবেশস্থলে পৌঁছাবেন। প্রথমে সেখানে রংপুর বিভাগের উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন। সফরে রংপুরে ২৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং পাঁচটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ঘোষণা দেবেন সরকারপ্রধান। মহাসমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার পর বিকেলে আবার একই পথে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় থাকতে পারে চমক : জিলা স্কুল মাঠের জনসভামঞ্চ থেকে ২০১১ সালের মতো আবারও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় চমক থাকতে পারে বলে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, শ্যামাসুন্দরী খাল খনন, রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনৈতিক জোন, বন্ধ চিনিকল খুলে দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা আসতে পারে জনসভা থেকে।
যেসব প্রকল্প উদ্বোধন করবেন : রংপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, কাজ শেষে প্রস্তুত হওয়া শেখ রাসেল মিডিয়া সেন্টার, শেখ রাসেল ইনডোর স্টেডিয়াম, শেখ রাসেল সুইমিংপুল, পীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জলাশয়ের জলাবদ্ধতা নিরসন শীর্ষক প্রকল্প, বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, পালিচড়া স্টেডিয়ামসহ ২৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার নির্মাণ, রংপুর জেলায় বিটাক কেন্দ্র স্থাপন, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়, রংপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অফিস ভবন এবং লেডিস হোস্টেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে রংপুরবাসীর যত চাওয়া : রংপুর বিভাগবাসীর পক্ষ থেকে নানাভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেসব দাবি জানানো হচ্ছে, এর মধ্যে রয়েছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, শ্যামাসুন্দরী খাল খনন, বন্ধ চারটি চিনিকল খুলে দেওয়া, রংপুর বিভাগের ৬টি স্থলবন্দর আধুনিকায়ন, অর্থনৈতিক জোন, কৃষিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে এক হাজার শয্যায় উন্নীত করা, জামালপুর-রৌমারী ও চিলমারী-পঞ্চগড় রেল সংযোগ স্থাপনসহ বিভিন্ন দাবি।
রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, রংপুরবাসী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনেক চাওয়া আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ স্থগিত আছে, সেটি চালু করা, রংপুরে গ্যাসের পাইপলাইন দেওয়া, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা অন্যতম।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী কথা রেখেছেন। বিগত সময়ে তিনি নিজ দায়িত্বে এলাকার উন্নয়ন করেছেন। তবে দেশের অন্য অঞ্চলের থেকে রংপুর কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রী আমাদের অনেক কিছুই দেবেন, যা প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি হবে।
মন্তব্য করুন