শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দায়িত্ব নিয়েই রাষ্ট্র সংস্কার করতে কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরই মধ্যে নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কারসহ ছয়টি কমিশন পূর্ণাঙ্গভাবে গঠন করেছে সরকার। গতকাল সোমবার গণমাধ্যম ও স্বাস্থ্যসহ আরও পাঁচটি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে কমিশনগুলো গঠনের বিষয়ে জানানো হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার অনুশাসন অনুযায়ী, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্যদের নাম প্রকাশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সংস্কার কমিশনগুলোতে একজন করে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রাখা হলেও শ্রম এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনে শিক্ষার্থীর নাম প্রকাশ করা হয়নি।
কমিশন প্রধান হলেন যারা: জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়েছেন সিনিয়র সাংবাদিক কামাল আহমেদ। শ্রম অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে থাকবেন শিরীন পারভীন হক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের নেতৃত্ব দেবেন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ৯০ দিনের মধ্যে কমিশন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করবে। প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে কমিশনপ্রধান ও সদস্যরা চাইলে বিনা বেতনে কাজ করতে পারবেন। কমিশনের কার্যালয় ও সদস্যদের সুযোগসুবিধা ঠিক করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন: বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি প্রফেসর এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য করা হয়েছে ১১ জনকে। তারা হলেন বিএসএমএমইউর জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ইনফরমেটিক অধিদপ্তরের প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, পথিকৃৎ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর লিয়াকত আলী, গাইনোকলজিস্ট প্রফেসর ডা. সায়েবা আক্তার, শিশু স্নায়ুতন্ত্র বিভাগের প্রফেসর ডা. নায়লা জামান খান, সাবেক সচিব এম এম রেজা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল) প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক, আইসিডিডিআরবি,র ডা. আজহারুল ইসলাম, স্কয়ার হাসপাতালের স্কয়ার ক্যান্সার সেন্টারের প্রফেসর ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, গ্রিন লাইফ সেন্টার ফর রিউম্যাটিক কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চের চিফ কনসালট্যান্ট প্রফেসর ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, আইসিডিডিআরবি,র শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী উমায়ের আফিফ।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন: সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বাধীন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিসহ সদস্য করা হয়েছে ৯ জনকে। সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, সম্পাদক পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সচিব আখতার হোসেন খান, অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন ওনার্সের (অ্যাটকো) প্রতিনিধি, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের ট্রাস্টি ফাহিম আহমেদ, মিডিয়া সাপোর্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ও সাংবাদিক জিমি আমির, দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া জেলা প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ডেপুটি এডিটর টিটু দত্ত গুপ্ত। এ ছাড়া শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন।
শ্রম সংস্কার কমিশন: বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন এ কমিশনেও ৯ জন সদস্য আছেন। তারা হলেন সাবেক সচিব ড. মাহফুজুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সভাপতি তপন দত্ত, বাংলাদেশ লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এ কে এম নাসিম, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ম. কামরান টি রহমান, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সভাপতি চৌধুরী আশিকুল আলম, বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সাকিল আখতার চৌধুরী, আলোকচিত্রী ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠক তাসলিমা আখতার। এ ছাড়া এই কমিশনে একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকবেন। তবে তার নাম প্রকাশ করা হয়নি।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন: নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হক এ কমিশনের প্রধান। সদস্য করা হয়েছে ৯ জনকে। তারা হলেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো মাহীন সুলতান, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আক্তার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতান এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়েছেন। কমিশনে কাজ করবেন সাত সদস্য। তারা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান, সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুর রহমান, বিআইএসএসের পরিচালক ড. মাহফুজ কবির, নারী উদ্যোগ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মাসুদা খাতুন শেফালী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তারিকুল ইসলাম। এ ছাড়া একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকবেন। তার নাম প্রকাশ করা হয়নি।
আগের ছয় কমিশন: গত ১১ সেপ্টেম্বর সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে কমিশন গঠন করার ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপর গত ১৭ অক্টোবর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান স্বাস্থ্য, গণমাধ্যমসহ আরও চার বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠনে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। গতকাল সোমবার পাঁচটি কমিশন পূর্ণাঙ্গ হওয়ায় সংস্কার কমিশনের মোট সংখ্যা দাঁড়াল ১১টিতে। সরকার প্রয়োজন মনে করলেও আরও কমিশন গঠন করবে। এসব কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কার করবে অন্তর্বর্তী সরকার।