কোনো বিজ্ঞপ্তি কিংবা পরীক্ষা ছাড়াই ‘যেনতেনভাবে’ পদোন্নতি পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত সোমবার কমিশনে অনুষ্ঠিত এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এসব পদোন্নতি দেওয়া হয়। এমন পদোন্নতি দেওয়ায় কম্পিউটার অপারেটর হয়ে গেছেন তৃতীয় গ্রেডের অতিরিক্ত পরিচালক, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা হয়ে গেছেন উপপরিচালক। শুধু তাই নয়, পদোন্নতি দেওয়ার জন্য গঠিত কমিটির একজন সদস্য কমিটিতে থেকে নিজেই নিজের পদোন্নতি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দাবি জোরালো হলেই পদোন্নতি পাওয়া যাচ্ছে—এমন খবর ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই পদোন্নতির দাবিতে কমিশনের চেয়ারম্যান, সচিব ও সদস্যদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। আবার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পদোন্নতি দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ায় ইউজিসিতে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দৈনন্দিন কাজের চেয়ে পদোন্নতির বিষয়টি এখন সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে নিয়েছে।
জানা গেছে, পদোন্নতি বা পদোন্নয়ন দেওয়ার জন্য গত ২৩ অক্টোবর ছয় সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে ইউজিসি। যেখানে ইউজিসি সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং সহকারী সচিব (প্রশাসন) নাসরিন সুলতানাকে সদস্য সচিব করা হয়।
এ ছাড়া সদস্য হিসেবে রাখা হয় অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক মো. রেজাউল করিম হাওলাদার, যুগ্ম সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুহম্মদ নাজমুল ইসলাম, প্রশাসন বিভাগের উপসচিব নূরনাহার বেগম শিউলী এবং উপসচিব (প্রশাসন) মো. আসাদুজ্জামানকে। যাদের পরামর্শ অনুযায়ী গত সোমবার এ পদোন্নতি দেওয়া হয়।
অভিযোগ উঠেছে, শুধু দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে কমিশনের ২৮ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমন পদোন্নতির নজির নেই ইউজিসিতে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চাকরি প্রবিধানমালা ১৯৮৭-এর ১৯ ধারা (পদোন্নতি) অনুযায়ী, এভাবে পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ নেই।
আরও অভিযোগ উঠেছে, পদোন্নতির জন্য গঠিত কমিটির একজন সদস্য হয়েও পদোন্নতি পেয়েছেন যুগ্ম সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুহম্মদ নাজমুল ইসলাম। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও কেউ মুখ খোলেননি। নাজমুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে কমিটির সদস্য অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক রেজাউল করিম হাওলাদার বলেন, আমি কিছুই জানি না। প্রশাসন শাখা ভালো বলতে পারবে।
ইউজিসির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, সাতাশির প্রবিধান অনুযায়ী এভাবে পদোন্নতি দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। প্রথমে বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে, এরপর আবেদন, সেখান থেকে ভাইভা কার্ড, এরপর কমিশন ও মন্ত্রণালয়ের (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) কর্মকর্তাদের নিয়ে সিলেকশন কমিটি গঠনের পর তারা ভাইভা নিয়ে সুপারিশ করেন এবং পূর্ণ কমিশন নিয়োগ অনুমোদন করেন। এ ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। আবার কেউ জোর দাবি তুলতে পারলেই তাকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এটি ইউজিসির ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম ঘটনা।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, কমিশনে তৃতীয় শ্রেণির কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগ দিয়েছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। পরে পদোন্নতি পেয়ে ধাপে ধাপে শাখা কর্মকর্তা, সহকারী পরিচালক, সিনিয়র সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক পদে আসীন হন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির সব গ্রেডের চাকরির ক্ষেত্রে আপগ্রেডেশনের সুযোগ নেই। এ ছাড়া কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগদান করে ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত পরিচালক হয়েছেন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপপরিচালক সুরাইয়া ফারহানাও। উপপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া এসপিকিউএ বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মোরশেদ আলম খন্দকারের শিক্ষাজীবনে তৃতীয় শ্রেণি রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, তৃতীয় বিভাগ পাওয়া কোনো ব্যক্তি প্রথম শ্রেণির কোনো চাকরির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। তিনিও কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কমিশনে যোগদান করেছিলেন।
কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগদান করে সিনিয়র সহকারী পরিচালক হয়েছেন মামুনুর রশীদ খান (চেয়ারম্যানের দপ্তর), হারুন মিয়া ও মোয়াজ্জেম হোসেন সরকার (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগ), মামুন পাটওয়ারী ও আকতার পেরিস (রিসার্চ, সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন), মোরশেদ আহম্মদ (অর্থ ও হিসাব বিভাগ) এবং নূর ইসলাম চৌধুরী ও হাছিনা পারভীন (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগ)।
একই পদে যোগ দিয়ে সহকারী পরিচালক হয়েছেন মনিরুজ্জামান (রিসার্চ সাপোর্ট ও পাবলিকেশন), পারভেজ গাজী (সচিবের দপ্তর), সাজেদুর রহমান (অর্থ ও হিসাব বিভাগ) এবং আমিরুল ইসলাম (সদস্যের দপ্তর)। অফিস সহকারী থেকে সহকারী পরিচালক হয়েছেন আয়েশা আক্তার (রিসার্চ সাপোর্ট ও পাবলিকেশন)। ল্যাব সহকারী থেকে জসিম উদ্দীন (আইএমসিটি বিভাগ), অডিটর থেকে আবদুল্লাহ আল মামুন (অর্থ ও হিসাব বিভাগ) এবং এমএলএসএস থেকে কফিল উদ্দীন (জেনারেল সার্ভিসেস, এস্টেট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ)।
এদিকে অদ্ভুত ওই পদোন্নতির পর পরই ইউজিসির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী একই উপায়ে নিজেদের পদোন্নয়নের জন্য আবেদন করছেন। বুধবার সকালে ইউজিসিতে গিয়ে দেখা গেছে, সচিব, একজন সদস্য ও চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে ভিড়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন দাবিতে তারা গত দুদিন ধরে ভিড় করছেন। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হয়েছেন জানিয়ে পদোন্নতির মাধ্যমে সহকারী পরিচালক কিংবা উপপরিচালক হতে চান তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা চান তাদের ব্লক হওয়া পদোন্নতির দ্বার উন্মুক্ত হোক। পিয়ন ও ড্রাইভাররা পদোন্নতির সুযোগ না থাকলে ইনক্রিমেন্ট চান।
ইউজিসি সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বর্তমান প্রশাসন যারা ১৫ থেকে ১৬ বছর বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বলেছি, আমরা আগের অবস্থায় ফিরে যাব। এর মাধ্যমে যারা দীর্ঘদিন বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের পদ প্রাপ্তির একটি সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এক মাস ধরে প্রতিদিন সব স্তর থেকে শত শত আবেদন আসছে। কমিটি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। নতুন করে আর কাউকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে নয়। হয়তো পরবর্তী লটে নীতিমালা অনুমোদন হওয়া সাপেক্ষে সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পিয়নদের আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা গ্র্যাজুয়েট বা মাস্টার্স তাদের চাকরির ১৫ থেকে ২০ বছরপূর্তি সাপেক্ষে কম্পিউটার টেস্ট, পরীক্ষা নেওয়া সাপেক্ষে একটি সুযোগ দেওয়া হবে। তৃতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ছয় বছরের চাকরি, অনার্স, মাস্টার্স থাকলে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সাপেক্ষে তাকে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা করা যাবে। এগুলো কমিটি বিবেচনা করবে।
তবে সচিব পদোন্নতির বিষয়টি স্বীকার না করলেও বুধবার বিকেলেই আবার অন্তত পাঁচজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কাগজপত্র অনুযায়ী, জেনারেল সার্ভিসেস এস্টেট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের উপপরিচালক মুহাম্মদ মাসুদ হোসেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপপরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ আকরাম আলী খানকে অতিরিক্ত পরিচালক করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক নাহিদ সুলতানাকে এস্টেট বিভাগের পরিচালক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, চাকরির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কোনোরূপ পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন। এ ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক জেসমিন পারভীনকে ইন্টারন্যাশনাল কোলাবোরেশন বিভাগের পরিচালক করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ কালবেলাকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গায়ের জোরে অনেককে বঞ্চিত করা হয়েছে। অনিয়ম ও বঞ্চনা থেকে এখানকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বের করে আনা এবং শতভাগ ন্যায়বিচার নিশ্চিতের চেষ্টা করেছি। তাদের মর্যাদার জায়গা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে তারা কোনোভাবেই বকেয়া পাবেন না। পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কমিটিতে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি ভুলক্রমে এসেছে। তিনি কমিটিতে ছিলেন না। নতুন করে অনেক পদোন্নতির দাবি আসার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা দেখে দেখে সবকিছু করছি। তাদের কেউ ভুল বোঝাচ্ছে। আমরা তাদের সেটি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।