রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরই আলোচনায় আসে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি। চার বছর আগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রতিষ্ঠিত দলটি এখন বেশ সক্রিয়। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছে এবি পার্টি। এরপর ধীরে ধীরে দলটিতে জনসমর্থনও বাড়ছে। এরই মধ্যে সারা দেশে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগে কর্মিসভার মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করেছে এবি পার্টি। প্রতিষ্ঠার পর আজ শনিবার প্রথম জাতীয় কাউন্সিল ঘিরে আরও চাঙ্গা হচ্ছেন তারা। সম্মেলন ঘিরে উজ্জীবিত দলটির নেতাকর্মীরা। প্রথম কাউন্সিলে চেয়ারম্যান পদে তিন শীর্ষ নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। গতকাল শুক্রবার উৎসবমুখর পরিবেশে চেয়ারম্যান পদে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আজ জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে ফল ঘোষণা করা হবে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিরা সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু কালবেলাকে বলেন, আমরা প্রথম কাউন্সিল উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম। আল্লাহর রহমতে শুক্রবার চেয়ারম্যান পদে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দিনভর দেশ-বিদেশের কাউন্সিলররা ভোট প্রদান করেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তি ও পত্রিকার সম্পাদকরা ভোট গ্রহণ দেখতে আসেন। এবি পার্টি একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে কাজ করছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে বেরিয়ে আসা ও বহিষ্কৃতদের সমন্বয়ে রাজনৈতিক উদ্যোগ ‘জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে সংগঠনটিকে রিসার্চ উইং হিসেবে রেখে ২০২০ সালের ২ মে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী এএফএম সোলায়মান চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুকে সদস্য সচিব করে আত্মপ্রকাশ করে দলটি। শুরুর দিকে অনেকে বলছিলেন, জামায়াতের বিকল্প কোনো দল হিসেবে এবি পার্টির জন্ম! তবে দলটির প্রতিষ্ঠাতারা দাবি করেন, এবি পার্টি একেবারেই স্বতন্ত্র একটি দল। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ভাঙনের মুখে পড়েছিল এবি পার্টি। সে সময় দলের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আকস্মিক দল ছেড়ে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিতে যোগ দেন।
এদিকে ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি নিবন্ধনের আবেদন করে এবং প্রাথমিক বাছাইয়েও উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নিবন্ধন পায়নি। অতঃপর ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট হাইকোর্টের দেওয়া রায় ও আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ অধ্যায় ৬-এর বিধান অনুযায়ী দলটিকে ‘ঈগল’ প্রতীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এবি পার্টির ভাবাদর্শ হচ্ছে, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’। দলটির সহযোগী সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ, এবি যুবপার্টি ও এবি পার্টি-মহিলা শাখা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল রাজপথে সক্রিয় আন্দোলন করেছিল। বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎভাবে আন্দোলন করেছিল দলগুলো। সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল না এবি পার্টিও। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে এবি পার্টি নানামুখী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় ছিল। একই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিও পালন করেছে দলটি। গত বছর রোজার মাসে দলীয় কার্যালয়ের সামনে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার মানুষকে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করেছে এবি পার্টি। কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন ইস্যুতে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে এবি পার্টি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে দলটির পক্ষ থেকে বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। ফলে এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জুসহ অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়। একপর্যায়ে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতন হলে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় দলটি। এরপর দলটিতে ধীরে ধীরে জনসমর্থন বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
রাজধানীর বিজয় নগরে এবি পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সরেজমিন দেখা গেছে, প্রথম জাতীয় কাউন্সিল ঘিরে নেতাকর্মীর উপচে পড়া ভিড়, যা নিকট অতীতে খুব বেশি দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও নিবন্ধন পাওয়ার পর দলীয় কার্যালয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। দলটির সাধারণ নেতাকর্মীদের মতে, এবি পার্টি ২০২০ সালে আত্মপ্রকাশ করার পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পালন করতে দেয়নি। এমনকি দলীয় কার্যালয়ে কে আসছে না আসছে, এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার লোক দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হতো। প্রায় সময় র্যাবের টহল থাকত দলীয় কার্যালয়ের সামনে। একাধিকবার কেন্দ্রীয় অফিসে তল্লাশি চালিয়ে বিভিন্ন জিনিস তছনছ করা হয়েছে। এমনকি মিছিলে বাধা দিয়ে তা পণ্ড করেছে। নেতাকর্মীরা চাইলেও ঠিকমতো অফিসে অবস্থান করতে পারতেন না। এখন স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নেই, নেতাকর্মীরাও নিশ্চিন্তে সব ধরনের কর্মসূচি পালন করতে পারছেন। তারা জানান, প্রথম কাউন্সিল ঘিরে তারা আরও উজ্জীবিত। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে খুশির আমেজ বিরাজ করছে।
এদিকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সেবা ও সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক স্লোগানকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু করা এবি পার্টির চেয়ারম্যান পদে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দিনভর ভোট গ্রহণ চলে। এ বিষয়ে এবি পার্টির প্রচার সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল কালবেলাকে জানান, গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত প্রায় ২ হাজার ৮০০ কাউন্সিলর এই নির্বাচনে ভোট প্রদান করেছেন। দেশের কাউন্সিলররা সশরীরে উপস্থিত হয়ে, প্রবাসে ও অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিত কাউন্সিলররা অনলাইনে ভোট প্রদান করেছেন। নির্বাচনে এবি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক এএফএম সোলায়মান চৌধুরী, যুগ্ম আহ্বায়ক লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ভোট গণনা শেষে আজ জাতীয় কাউন্সিলে ঘোষণা করা হবে নির্বাচনের ফল। অবশ্য প্রথম দিকে চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রার্থী থাকলেও দলের বর্তমান আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার ও যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার যোবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন।
গতকাল সকাল থেকেই উৎসবমুখর পরিবেশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত ভোটকেন্দ্রে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কাউন্সিলরদের ভোট দিতে দেখা যায়। এবি পার্টির নেতারা জানান, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গত ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ৬০ জন প্রার্থীর বিপরীতে ২১ জন নির্বাহী পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। গতকাল চেয়ারম্যান পদে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। নির্বাহী পরিষদের সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে দলের সেক্রেটারি নির্বাচিত করবেন।