মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩, ০২:৩৮ এএম
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৫৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্ব মশা দিবস আজ

মশায় অসহায় মানুষ

মশায় অসহায় মানুষ

ছোট্ট একটি প্রাণী মশা। যার কাছে অসহায় গোটা বিশ্ব। মশাবাহিত রোগের প্রকোপে দেশে দেশে অতিষ্ঠ জনজীবন। কীটপতঙ্গের আক্রমণে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যান, তার মধ্যে মশাবাহিত রোগে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন মশাকে বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক প্রাণী বলে অভিহিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, মশাবাহিত রোগে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৭ লাখ মানুষ প্রাণ হারান। মশাবাহিত রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে আরও কয়েক কোটি মানুষ। বাংলাদেশেও ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১০০ প্রজাতি রোগ ছড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, মশা ২০টির মতো রোগ ছড়ায়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ইয়োলো ফিভার, জিকা, ফাইলেরিয়া, চিকুনগুনিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস রোগে।

মশাবাহিত রোগ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ২০ আগস্ট পালিত হয় বিশ্ব মশা দিবস। ১৯৩০ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন দিবসটি প্রথম পালন করা শুরু করে। ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট চিকিৎসক রোনাল্ড রস অ্যানোফিলিস মশাবাহিত ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কার করেছিলেন। চিকিৎসক রোনাল্ড রসের আবিষ্কারকে সম্মান জানানোর জন্য। পরবর্তীকালে তিনি এ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। কীটতত্ত্ববিদ এবং গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই ১৪টি প্রজাতির মশা পাওয়া যায়।

ম্যালেরিয়া: স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২১ সালে সারা বিশ্বে ২৪৭ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৬ লাখ ১৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। বিশ্বের মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের প্রায় ৯৫ শতাংশ আফ্রিকার নাগরিক। বৈশ্বিক মৃত্যুর ৯৬ শতাংশও আফ্রিকায় ঘটে। বাংলাদেশে মোট ৩৬ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা দেখা যায়, এর মধ্যে সাত প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। মূলত পার্বত্য ও সীমান্ত এলাকাতেই ম্যালেরিয়া বেশি দেখা যায়। এটি গ্রীষ্মকালে হয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ১৩টি জেলার ৭২টি থানায় ম্যালেরিয়া রোগের উপস্থিতি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, মারা যান ১৫৪ জন। পরে এ সংখ্যা কমে আসে।

ডেঙ্গু: ডেঙ্গু এখন বৈশ্বিক মহামারি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, রোগটি এখন বিশ্বের প্রায় ১০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বসবাসের এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। ৩.৬ বিলিয়ন মানুষ রোগটির ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ প্রতিবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে ১০০ মিলিয়ন মানুষ অসুস্থ হয়। আর মৃত্যু হয় ২১ হাজার। দক্ষিণ-মধ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, মেক্সিকো এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ঘুরে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটকদের মধ্যে একটি গবেষণা করে দেখা গেছে, এ পর্যটকদের বড় অংশ ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয় ২০১৯ সালে। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। চলতি বছরের শুরু থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত ৯৪ হাজার ৩১২ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৪৬ হাজার ১২৯ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ৪৮ হাজার ১৮৩ জন। চলতি বছরে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৪৬৬ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে গতকালও মারা গেছেন ১৩ জন।

এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

ইউয়োলো ফিভার: ইউয়োলো ফিভার হলো তীব্র ভাইরাল হেমোরেজিক রোগ, যা আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি হয়। ডব্লিউএইচওর তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ মানুষ ইউয়োলো ফিভার জ্বরাক্রান্ত হয়। এতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৮৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এ রোগের ৯৫ ভাগ রোগী চারটি দেশে শনাক্ত হয়। তার মধ্যে পেরুতে ৫৪ শতাংশ, বলিভিয়ায় ১৮ শতাংশ, ব্রাজিলে ১৬ শতাংশ এবং কলম্বিয়ায় ৭ শতাংশ। এ ছাড়া রোগটি আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, ফ্রেঞ্চ গায়ানা, গায়ানা, পানামা, প্যারাগুয়ে, সুরিনাম, ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো এবং ভেনিজুয়েলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

চিকুনগুনিয়া: চিকুনগুনিয়া রোগও এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ সাধারণ ভাইরাল ফিভারের মতো। ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজেস প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের (ইসিডিসি) তথ্যমতে, চলতি বছরের ২৬ জুলাই পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩ লাখ মানুষ চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে ব্রাজিলে ১ লাখ ৯২ হাজার ৮২২ জন, প্যারাগুয়ে ১ লাখ ১ হাজার ৯৬৩, আর্জেন্টিনায় ১ হাজার ৫৯৩, বলিভিয়ায় ১ হাজার ৩১১ ও থাইল্যান্ডে ৫৯৮ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হন। চলতি বছরের ৬ মাসে ৩০০টিরও বেশি মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ব্রাজিলের ৬০ জন এবং প্যারাগুয়ের ২৫৬ জন। ২০২৩ সালে ইউরোপে চিকুনগুনিয়ার কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে।

ফাইলেরিয়া: ফাইলেরিয়া রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। একে স্থানীয়ভাবে গোদ রোগও বলা হয়। মার্কিন যুক্তরোষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (সিডিসি) গত বছর আগস্ট পর্যন্ত তথ্যমতে, বিশ্বের ৭২টি দেশ ও অঞ্চলে লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়ার প্রদুর্ভাব রয়েছে। এসব অঞ্চলের ৫১ মিলিয়ন মানুষ মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়। কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি এবং ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশে ফাইলেরিয়া রোগ ছডায়। বাংলাদেশের ৩৪টি জেলায় ফাইলেরিয়া আক্রান্ত রোগী দেখা যায়।

জাপানিজ এনসেফালাইটিস: ১৯৭৭ সালে মধুপুর বনে প্রথম জাপানিজ এনসেফালাইটিস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। এরপর বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে এ রোগটি পাওয়া যায়। এ ছাড়া কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত দুই রোগী শনাক্ত হন। এরপর গত কয়েক বছরে আর জিকা ভাইরাস আক্রান্ত কাউকে শনাক্তের কথা শোনা যায়নি।

মশা দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, রোগ থেকে বাঁচতে মশাকেই নির্মূলে জোর দিতে হবে। আমাদের দেশে মশা নির্মূলের চেয়ে চিকিৎসায় বেশি জোর দেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের মশা নিধনে বেশি জোর দিতে হবে।

কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ছোট্ট একটা প্রাণীর কাছে পৃথিবীর মানুষ অসহায় হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সারা পৃথিবীজুড়ে গবেষণা হচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মশাবাহিত রোগের ভ্যাকসিন তৈরির শেষপর্যায়ে। একমাত্র ভ্যাকসিনের ওপরই ভরসা করার কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই ১৪টি প্রজাতির মশা পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মশাবাহিত পাঁচটি রোগের কথা জানা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জাপানিজ এনসেফালাইটিস।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গরিবের স্বপ্নেই থাকে ইলিশ

কেউ ছাই দেওয়া হাত থেকে বের হতে পারবে না : উপদেষ্টা বশিরউদ্দীন

বাংলাদেশে তিন বছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশে

রুট ১৩ হাজার রান ছুঁতেই মুখ খুললেন শচীন

‘উপদেষ্টা মাহফুজের ওপর হামলা হয়নি, কনস্যুলেট অফিস ভাঙচুর হয়েছে'

১৫০ টাকায় দেখা যাবে বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস টি-টোয়েন্টি ম্যাচ

সাব্বিরকে পাঁচ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ বিসিবির আকুর

জিয়ার সমাধিতে ডা. সাবরিনার শ্রদ্ধা, যুবদল সভাপতির ক্ষোভ

শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিতর্ক, অর্থপাচার বিরোধী অভিযানে চাপ

অভিনেত্রী জাহানারা ভূঁইয়া মারা গেছেন

১০

ঢাকা শিশু হাসপাতাল শাখা ড্যাবের নতুন দায়িত্বে ডা. ফারুক

১১

এনসিপির আরও চার নেতার পদত্যাগ 

১২

হাইকোর্টের বিচারপতি হলেন সারজিসের শ্বশুর লুৎফর রহমান

১৩

ডাকসু নির্বাচনে প্রচারণার বিধিমালা প্রকাশ

১৪

হাসনাতকে ‌‘ফকিন্নির বাচ্চা’ বললেন রুমিন ফারহানা

১৫

বিজিবির কাছে ৫ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করল বিএসএফ

১৬

চুরির অভিযোগ, গণপিটুনিতে যুবক নিহত

১৭

সংবিধানের মূলনীতি থেকে আমরা সরে যাচ্ছি : ড. কামাল হোসেন

১৮

রাকসু নির্বাচনে ভোটাধিকারের দাবিতে নবীন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৯

চট্টগ্রামের মিষ্টি কারখানায় স্বাস্থ্যঝুঁকি, মধুবন ফুডকে জরিমানা

২০
X