মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০২:৫৫ এএম
আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০২৩, ১১:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পাঁচ ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টে শিক্ষক সংকট চরমে

সরকারি মেডিকেল কলেজে পাঠদানে বেহাল দশা
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সরকারি মেডিকেল কলেজে পাঠদানে অভিজ্ঞ ও সিনিয়র শিক্ষকের অস্বাভাবিক সংকট চলছে। বেসিক সাবজেক্টের মতো ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টেও সংকট রয়েছে। অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদের বিপরীতে ৫০ শতাংশের বেশি পদ শূন্য। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর ৪ হাজার ৩৫০ শিক্ষার্থী ভর্তি হন। শিক্ষক সংকটে হাজারো শিক্ষার্থীর একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি মেডিকেল কলেজে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও অবস, পেড্রিয়াট্রিকস ও অর্থোপেডিক্স বিভাগে ৬৪২টি অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদের বিপরীতে ৩৬৮ পদ শূন্য! আবার অবসর ও চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগজনিত কারণে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি ও প্যাথলজির মতো মৌলিক বিষয়েও প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষকের রয়েছে সংকট। একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন, সাতটি মৌলিক বিষয়ের দু-একটি ছাড়া অধিকাংশ বিষয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ না থাকায় জুনিয়র চিকিৎসকদের কেউ আর এখন এসব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইছেন না। আবার ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টেও সংকট কাটছে না। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ও উদ্যোগ নিচ্ছে না।

রাজধানীর সরকারি মেডিকেল কলেজে প্রয়োজনীয় পদের বিপরীতে কিছু অধ্যাপক থাকলেও ঢাকার বাইরের কলেজগুলোতে অধ্যাপক যেন সোনার হরিণ। সারা দেশের মেডিসিন বিভাগের ৯৬টি পদের মধ্যে ৬৪ পদই শূন্য। ঢাকার বাইরের ২২ কলেজে মেডিসিন বিভাগে নেই কোনো অধ্যাপক। মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপকশূন্য নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, সুনামগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, যশোর মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ, মাগুরা মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, নাওগাঁ মেডিকেল কলেজ, নেত্রোকোনা মেডিকেল কলেজ, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ, পাবনা মেডিকেল কলেজ, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ এবং বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে একসঙ্গে মাগুরা, নওগাঁ, নেত্রকোনা, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও শিক্ষক, অবকাঠামোসহ রয়েছে অন্যান্য সংকট। ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি নওগাঁ ২৫০ শয্যা হাসপাতালের পুরোনো ভবনের দুই তলার একটি অংশে ৫০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় নওগাঁ মেডিকেল কলেজের। এরপর আরও চারটি ব্যাচ মিলে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে কলেজে ২০টি বিভাগে পাঠদান কার্যক্রম চলমান। প্রতিটি বিভাগে অন্তত একজন করে সহকারী অধ্যাপক ও দুজন করে প্রভাষক দরকার। কিন্তু ফরেনসিক মেডিসিন, প্যাথলজি ও বায়োকেমিস্ট্রির মতো বিভাগসহ বেশ কিছু বিভাগে একজন করে প্রভাষক দিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। কলেজের শিক্ষার্থী পার্থ সরকার জানান, নতুন মেডিকেলের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পর্যাপ্ত ল্যাব ফ্যাসিলিটি না থাকায় আমরা অনেক কিছুই শিখতে পারছি না। অধ্যক্ষের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন বিভাগের ৭৮টি পদ রয়েছে। তবে বর্তমানে রয়েছেন অধ্যক্ষসহ ৪০ জন।

মাগুরা মেডিকেল কলেজের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। মেডিকেল কলেজটিতে বিভিন্ন বিভাগের ৯৭ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ২৫ জন। কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মাগুরা মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন বিভাগের ৯৭টি পদ রয়েছে। অধ্যক্ষসহ মাত্র ২৫ জন কর্মরত। পদ শূন্য আছে ৭২টি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুমোদিত জনবল কাঠামো অনুযায়ী কলেজে ১১ জন অধ্যাপক থাকার কথা। অথচ কলেজটিতে শুধু অধ্যক্ষেই অধ্যাপক। সহযোগী অধ্যাপকের ১৯টি পদের মধ্যে খালি ১২টি। তিনজন চলতি দায়িত্বসহ আছেন সাতজন। সহকারী অধ্যাপক ১৯ জনের মধ্যে আছেন ১০ জন। এর মধ্যে একজন সহকারী অধ্যাপক বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গেছেন। খালি আছে আরও ৯টি পদ। অ্যানাটমি ও প্যাথলজি বিভাগে কিউরেটরের দুটি পদই ফাঁকা। আর সবচেয়ে বড় সংকট প্রভাষক পদে। অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি—প্রতিটি বিষয়ে চারজন এবং মাইক্রোবায়োলজি, কমিউনিটি মেডিসিন ও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে দুজন করে মোট ২৬ প্রভাষকের পদ রয়েছে এই মেডিকেল কলেজে। সেখানে আছেন মাত্র চারজন। ফাঁকা রয়েছে ২২টি পদ। ল্যাব টেকনোলজিস্টসহ প্রশাসনিক যে ১৯ পদ আছে, সেখানে শূন্য আছে ১৬টি পদ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক সংকট প্রকট। এই বিভাগে একজন প্রভাষক দিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। যেখানে কমপক্ষে একজন সহকারী অধ্যাপক ও দুজন প্রভাষক দরকার। শিক্ষক সংকটে শিক্ষার্থীদের কী ক্ষতি হচ্ছে—জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংকট নিয়েই যদি চলতে হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের জানার ঘাটতি থেকে যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও অবস, পেড্রিয়াট্রিকস ও অর্থপেডিকস বিভাগে পাঁচ ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টে ১ হাজার ১৭৯টি পদ রয়েছে। এসব বিষয়ে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদ রয়েছে ৬৪২টি। তার মধ্যে শিক্ষকের শূন্য পদ রয়েছে ৩৬৮। পাঁচটি ক্লিনিক্যাল বিষয়ে ২৫৭টি অধ্যাপক পদের মধ্যে ১৫৪ পদে নেই কোনো অধ্যাপক। ৩৮৫ সহযোগী অধ্যাপক পদের বিপরীতে ফাঁকা রয়েছে ২১৪টি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব কালবেলাকে বলেন, দেশের মেডিকেল শিক্ষায় শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিনের। শুধু বেসিক সাবজেক্ট নয়, সবখানেই। মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সংকট নিরসনে সরকার উদ্যোগ না নিলে দক্ষ চিকিৎসক তৈরির পথ সংকুচিত হবে। এ ক্ষেত্রে বেসিক সাবজেক্টের শিক্ষকদের গবেষণায় ও বেতন-ভাতায় প্রণোদনা দিতে হবে। তাহলে বেসিক ও ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টে লোকবল পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, মেডিকেল শিক্ষার সংকট নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। অথচ ভালো পাঠদান সম্ভব না হলে ভালো চিকিৎসক তৈরি হবে না। দেশের মেডিকেল কলেজগুলো শিক্ষক, যন্ত্রপাতিসহ নানা সংকটে ভুগছে। এ খাতে সবার নজর খুবই কম। অথচ চিকিৎসা শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া দরকার। বেসিক সাবজেক্টে শিক্ষক পাওয়া যায় না। ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টেও রয়েছে সংকট। এক্ষেত্রে পরামর্শ হলো, সুনির্দিষ্টভাবে প্রণোদনা দিয়ে শিক্ষক তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে মেডিকেল কলেজ অনুমোদনের সঙ্গে পদসৃজন ও নিয়োগ কাঠামো তৈরি করতে হবে। উদ্বোধনের দিন যেন পূর্ণাঙ্গ শিক্ষক নিয়েই চালু করা যায়। নয়তো ভবন উদ্বোধন হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষক সংকট থেকে যাচ্ছে। এভাবে মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।

এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো টিটো মিঞাকে তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সংকট মোকাবিলায় মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা জানতে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের চিকিৎসা শিক্ষা অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব ড. রনজিৎ কুমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এ পদে নতুন যোগদান করায় তেমন কিছু জানাতে পারেননি। তবে শিক্ষক সংকট নিরসনে সরকার ইতিবাচক বলে কালবেলাকে তিনি জানান।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সৌদিগামী যাত্রীদের জন্য সুখবর

এমবাপ্পের একমাত্র গোলে রিয়ালের কষ্টার্জিত জয়

ম্যানসিটি ছাড়ছেন আর্জেন্টিনার ‘নতুন মেসি’

‘৫১ লাখ টাকার স্টেডিয়াম ১৪ কোটিতে করার অনুমোদন’, কী ব্যাখ্যা দিলেন সচিব

জনপ্রিয় ব্রিটিশ পত্রিকায় বাংলাদেশ নারী দলের প্রশংসা

ইউআরপি ও ডিএলআর মডিউল প্রস্তুত / মালয়েশিয়ায় শ্রমিক যাবে শূন্য অভিবাসন ব্যয়ে

রাশিয়া শক্তিশালী, এটা মেনে নিতেই হবে : ট্রাম্প

ময়মনসিংহ থেকে বাস চলাচল শুরু, ভাঙচুরের ঘটনায় কমিটি

আইপিএলে ভালো করলেও ভারত দলে জায়গা নিশ্চিত নয়

ফেব্রুয়ারির কত তারিখে রোজা শুরু হতে পারে 

১০

দুই শিক্ষককে প্রাণনাশের হুমকি প্রদানের ঘটনায় আহমাদুল্লাহর উদ্বেগ

১১

সরকারি কর্মচারীরা দাফনের জন্য পাবেন টাকা

১২

দেড় যুগেও নির্মাণ হয়নি জহির রায়হান মিলনায়তন

১৩

দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা, দুই উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি

১৪

৫ অভ্যাসে বার্ধক্যেও ভালো থাকবে হৎপিণ্ড

১৫

অনশন প্রত্যাহার করল বেরোবি শিক্ষার্থীরা

১৬

‘ভুল চিকিৎসায়’ একদিনে দুই শিশুর মৃত্যু

১৭

সরকারি কর্মচারীদের জন্য সুখবর

১৮

কাভার্ডভ্যানের চাপায় মা-মেয়ের মৃত্যু

১৯

মাস্ক পরে হাসপাতালে দীপু মনি

২০
X