মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৫ মে ২০২৫, ০৮:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাস্তবতায় বিপন্ন একান্নবর্তী পরিবার

আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস
বাস্তবতায় বিপন্ন একান্নবর্তী পরিবার

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ব্যাংকার মোহাম্মদ ইরফান (৩৯)। তার শৈশব কেটেছে একান্নবর্তী পরিবারে। শিক্ষাজীবন থেকে তিনি রাজধানীর বাসিন্দা। এখন স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে তার ছোট্ট পরিবার। শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানান, দুই ভাই, এক বোন বাবা, মা ও তিন চাচার পরিবার নিয়ে ছিল তাদের একান্নবর্তী পরিবার। শান্ত সবুজ গ্রামে ভাইবোনদের সঙ্গে কেটেছে হৈহুল্লোড়ে। কালক্রমে এখন তাদের সবাই বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছেন। সন্তানরাও বঞ্চিত হচ্ছে স্বজনদের স্নেহ ও মায়া থেকে। তার ছোটভাই মুশফিকুর রহমানও পরিবার ছেড়ে সরকারি চাকরি সূত্রে পাবনায় বসবাস করেন। উৎসব ছাড়া কারও সঙ্গে আগের মতো দেখা নেই তাদের। একই চিত্র পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা মুরাদ হাসানের বেলায়। একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তাদের শৈশব কেটেছে শরীয়তপুরের গ্রামে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ছয় ভাইবোনের কেউ আর একসঙ্গে নেই। জীবিকার তাগিদে ছড়িয়ে আছেন দেশের বিভিন্ন জেলা ও প্রবাসে। আদিম পেশা কৃষিতে অভ্যস্ত সমাজে একান্নবর্তী পরিবারের আধিক্য থাকলেও শিল্পায়নের কল্যাণে মানুষ ছেড়েছে পরিবারের মায়া। জড়িয়েছে বিভিন্ন পেশায়। ফলে ভেঙে গেছে একান্নবর্তী পরিবারের ঐতিহ্য। পরিবার ছোট হওয়ার পেছনে জনসংখ্যাবিশারদরা বলছেন, চাকরিসূত্রে কিংবা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কারণে একান্নবর্তী পরিবার ভাঙছে।

অথচ রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একক বলা হয় পরিবারকে। সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করতে গিয়ে মানুষ পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। বাঙালির ঐতিহ্যে একান্নবর্তী পরিবারের প্রথা প্রচলিত থাকলেও সেখানে ক্ষুদ্র ও একক পরিবারের আধিক্য তৈরি হয়েছে। পরিবারের সদস্যের আকার ছোট হয়ে চারের নিচে নেমে গেছে। এক দশক আগে ছিল প্রায় সাড়ে চারজন। সেটি কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ জন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবারে ভাঙনের সুর। যার অন্যতম কারণ পরকীয়া। বিবিএসের প্রতিবেদনে তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছিন্ন হওয়ার পেছনে ১৫টি কারণ উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে পরকীয়ার দায় সবচেয়ে বেশি—২২ দশমিক ৬ শতাংশ। দ্বিতীয় কারণ দাম্পত্য জীবন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অক্ষমতা। ব্যয় বহনে অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপের মতো ঘটনাও রয়েছে। পরকীয়ায় সংসার ভাঙার প্রবণতা অঞ্চলভিত্তিক বিভাজনে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগে—২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয় রংপুর বিভাগে ২৬; সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ।

এমন বাস্তবতায় আজ ১৫ মে, বৃহস্পতিবার দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। পরিবারের প্রতি গুরুত্ব ও সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছরই এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৯৩ সালে বিশ্বজুড়ে পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে ও পরিবারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে জাতিসংঘ ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের ঘোষণা করে। দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে পরিবারের গুরুত্ব তুলে ধরতে সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, র‌্যালি জাতীয় নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এক হিসাবে দেখা গেছে নারীদের তালাকের আবেদন হার বেশি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তথ্য মতে, ২০২০ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তালাকের আবেদন পড়েছে ৬ হাজার ১৬৮টি। এর মধ্যে নারী করেছেন ৪ হাজার ৫৩টি আর পুরুষ করেছেন ২ হাজার ১১৫টি। মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ৩ হাজার ৪৪২টি। ২০২১ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৭ হাজার ৪১৪টি। ৪ হাজার ৮১টি আবেদন করেছেন নারী। আর ১ হাজার ৭৬২টি আবেদন করেছেন পুরুষ। এ বছর মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৪টি। ২০২২ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৫ হাজার ৫৯০টি। ৩ হাজার ৬৩৭টি আবেদন করেছেন নারী। আর ২ হাজার ২টি আবেদন করেছেন পুরুষ। মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ৪ হাজার ২১১টি। ২০২৩ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৬ হাজার ৩৯৯টি। ৪ হাজার ১৮২টি তালাকের আবেদন করেছেন নারী। আর ২ হাজার ২১৭টি আবেদন করেছেন পুরুষ। এ বছরে মোট তালাক কার্যকর হয় ৩ হাজার ৪৩৫টি। ২০২৪ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে গড়ে ২ হাজার ৫২১টি। ১ হাজার ৫৬১টি তালাকের আবেদন করেছেন নারীরা। আর ৯৬০টি আবেদন করেছেন পুরুষ। মোট তালাক কার্যকর হয় ১ হাজার ৫০৮টি। এ সিটিতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গত পাঁচ বছরে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ২৮ হাজার ৯২টি। এর মধ্যে পুরুষরা আবেদন করেছেন ৯ হাজার ৫৬টি এবং নারীরা করেছেন ১৭ হাজার ৫১৪টি।

একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) গত পাঁচ বছরে তালাকের আবেদন পড়েছে ৩৬ হাজার ৫০৭টি। এর মধ্যে ২৬ হাজার ৪৪টি আবেদন করেছেন নারীরা আর ১০ হাজার ৪৬৩টি আবেদন করেছেন পুরুষ। ডিএসসিসির তথ্যমতে, ২০২০ সালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তালাকের আবেদন পড়েছে ৬ হাজার ৩৪৫টি। ৪ হাজার ৪২৮টি আবেদন করেছেন নারী। আর এ বছরে ১ হাজার ৯১৭টি আবেদন করেছেন পুরুষ। ২০২১ সালে মোট তালাকের আবেদন পড়েছে ৭ হাজার ২৪৫টি। ৫ হাজার ১৮৩টি আবেদন করেন নারী। আর ২ হাজার ৬২টি আবেদন করেন পুরুষ। ২০২২ সালে মোট তালাকের সংখ্যা ৭ হাজার ৬৯৮টি। নারীরা করেছেন ৫ হাজার ৩৮৩টি। আর পুরুষ ২ হাজার ৩১৫টি। ২০২৩ সালে মোট তালাকের আবেদন ৭ হাজার ৩০৬টি। নারীরা করেছেন ৫ হাজার ২৮৬টি। আর পুরুষ ২ হাজার ২০টি। ২০২৪ সালে মোট তালাকের আবেদন সংখ্যা ৭ হাজার ৯১৩টি। নারীরা করেছেন ৫ হাজার ৭৬৪টি। পুরুষ আবেদন করেছেন ২ হাজার ১৪৯টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল আই খান কালবেলাকে বলেন, সারা পৃথিবীতেই পরিবারের আকার ছোট হয়ে আসছে। কৃষি সমাজ থেকে শিল্পায়িত সমাজে স্থানান্তর হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা জন্ম নেয়। ধরুন, কৃষি পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা কেউ একজন ঢাকায় করপোরেট চাকরি শুরু করলেন। তিনি নিজের ক্যারিয়ার, সন্তান ও সংসারের খরচ বহন করা নিয়ে চিন্তিত থাকেন। কারণ আয় তো সীমিত। ফলে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না। আবার যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন, তাহলে সকাল থেকে দুজনেই ব্যস্ত। ফলে আত্মীয়স্বজন ঢাকার বাসায় এলে তাকে সেভাবে সময় দেওয়া হয়ে উঠে না। এসব কারণে আমরা বলি, বাস্তবতার আলোকে পারিবারিক পরিসীমাকে ছোট করতে হচ্ছে। যেহেতু আমরা নগরায়িত সমাজে থাকি।

তিনি বলেন, আপনি হয়তো দায়িত্ব হিসেবে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু কর্মস্থল থেকে ফেরার পর আপনার স্ত্রী হয়তো তার শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলাকে দায়িত্ব হিসেবে নেন না। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে ঘরের বউয়ের উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল শাশুড়ির সবসময় খোঁজখবর নিতে হবে। ভালো লাগলেও এটা কর্তব্য, খারাপ লাগলেও এটাই তার দায়িত্ব। যখনই সমাজের রূপান্তর ঘটে তখন আগের সমাজের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। গ্রামে আগে সালিশ বসত, নগরে সালিশ হয় না। এখানে থানায় যেতে হয়। আগের সমাজের প্রথা নগরায়ণে খাপ খাওয়াতে পারে না। সমাজ পাল্টে যাচ্ছে, মানুষও বদলে যাচ্ছে। তবে এর মধ্যেও একান্নবর্তী পারিবারিক প্রথা ধরে রাখতে পারলে ভালো। কারণ মানুষ তো সমাজবদ্ধ প্রাণী। একা একা ভালো থাকা যায় না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কাশ্মীরে আবারও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ, নিহত ৩

এবার ‘বোতল-বোতল’ স্লোগানে জবি শিক্ষার্থীরা

শ্রম বাজার নিয়ে বাংলাদেশকে বড় সুখবর মালয়েশিয়ার

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে রেকর্ড প্রাইজমানি, বাংলাদেশ পাবে কত?

সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে যেসব জায়গায় হতে পারে ঝড়

চলমান আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন সাবেক জবি শিক্ষার্থীরা

ঢাবির প্রশাসনিক ভবনে‌ জোরপূর্বক তালা দিল ছাত্রদল-বাম 

আইপিএলে খেলার অনুমতি পাচ্ছেন মোস্তাফিজ

টি সিরিজে ইশতিয়াক আহমেদের গান

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাটডাউন ঘোষণা

১০

জমির বিরোধে দুপক্ষের সংঘর্ষে যুবক নিহত

১১

থাইল্যান্ড পালানোর সময় বিএনপি নেতা আটক

১২

এবার ৪৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা থেকে উঠছে সিরিয়া

১৩

কালবৈশাখীতে লন্ডভন্ড ২ শতাধিক ঘর-বাড়ি

১৪

সাবেক মেয়র তাপসের বিশেষ প্রতিনিধি গ্রেপ্তার

১৫

পাক-রাজনীতিতে সুবাতাস / সমঝোতায় বসবেন শেহবাজ-ইমরান

১৬

শ্বশুরবাড়ি থেকে যুবকের মরদেহ উদ্ধার

১৭

শিগগিরই সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেওয়া হবে : প্রেস সচিব

১৮

‘ভোটে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে’

১৯

তেজগাঁওয়ে শিশু রোজা মনি মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার দাবি ড্যাবের

২০
X