দিন যতই যাচ্ছে, জনসংখ্যা বাড়ছে। বিপরীতে কমে আসছে বন ও কৃষিজমি। ফলে ধীরে ধীরে প্রকৃতির বাস্তুসংস্থান নষ্ট হচ্ছে। এতে বাড়ছে মানুষ-সরীসৃপ সংঘাত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মারা পড়ে সাপ, কিছু ক্ষেত্রে মানুষ। মানুষের আবাসস্থলের আশপাশে ছয় প্রজাতির বিষধর সাপের বসবাস। মারা যাচ্ছে পরিবেশের জন্য উপকারী গুইসাপও। এই প্রেক্ষাপটে আজ ১৬ জুলাই সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব সাপ দিবস।
বিশ্বে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। আর বাংলাদেশে ৯০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এসবের মধ্যে ৫ শতাংশ বিষধর। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার, কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়, নায়া নায়া (কোবরা বা গোখরা প্রজাতির সাপ), কেউটে, ক্রেইট বা শঙ্খিনী ও নায়া কাউচিয়া। এর মধ্যে রাসেলস ভাইপার সবচেয়ে বিষাক্ত। এ সাপটি একশ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গত ১০-১২ বছর আগে থেকে আবার এ সাপের দেখা মিলছে। বর্তমানে ২৭টি জেলায় এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
আধুনিক যুগে গবেষকরা অসংখ্য সাপের প্রজাতি সম্পর্কে জানতে পারার আগেই সরীসৃপটিকে প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনিতে বহুবার পাওয়া গেছে। ওষুধ তৈরিরও একটি উপাদান সাপের বিষ। বিশ্বে সাপের বিষের বাজার কোটি কোটি মার্কিন ডলার।
২০২০ সালে এশিয়ান জার্নাল অব এথনোবায়োলজি নামে আন্তর্জাতিক জার্নালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এবং তার গবেষণা দলের করা ‘স্টুডেন্ট পারসেপশন অন স্নেইক ইন নর্থ ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গে সাপ সম্পর্কে মানুষের ধারণা নিয়ে এ গবেষণা করা হয়।
এতে দেখা যায়, ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ ক্ষতিকর প্রাণী, ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ মানুষকে আক্রমণ করে, ৯২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ এলাকায় সাপ মারতে দেখেছে, ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজেরাই সাপ মেরেছে আর ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সাপ মারার মাধ্যমে আনন্দ পায়।
সাপ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকা ভ্রান্ত ধারণাও গবেষণায় ওঠে আসে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫২ শতাংশ মনে করে সাপের মণি আছে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায় সাপুড়ের বীণের তালে সাপ নাচে। ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ দুধ খায়; কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, সাপ কোনো ধরনের তরল খাদ্য গ্রহণে অক্ষম। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে সাপ প্রতিশোধ নিতে পারে।
এ গবেষণা থেকে বোঝা যায়, সাপ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এখনো অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। শুধু ভুল ধারণা আর কুসংস্কারের কারণেই প্রাণ হারাচ্ছে পরিবেশ ও কৃষির উপকারী সাপ। যেমন দাঁড়াশ বিষাক্ত সাপ নয় মোটেই। মানুষ এটিকে বিষাক্ত সাপ মনে করে একে দেখামাত্র প্রাণে হত্যা করে থাকে। আর এর ফলেই এ নির্বিষ দাঁড়াশ সাপগুলোর জীবন বর্তমানে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে। এ সাপের প্রধান খাবার ইঁদুর। ফসলের ক্ষতিকর ইঁদুর খেয়ে এরা কৃষক এবং উৎপাদিত কৃষিপণ্যের অভাবনীয় উপকার সাধন করে চলেছে। এ উপকারী সরীসৃপ প্রাণীটির প্রতি আরও সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার চালানোর কথা বলেন তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, সাপ নিজে থেকে কখনো মানুষের ক্ষতি করে না। যতক্ষণ না পর্যন্ত তার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাপ আমাদের শত্রু নয়। এটা পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে।
মন্তব্য করুন