প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পুষ্টি নিশ্চিতে সরকারের নেওয়া ‘স্কুল ফিডিং’ প্রকল্পের শুরুতেই দেখা দিয়েছে দরপত্র বিতর্ক। সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে তুলনামূলক বেশি দামে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে অন্য এক প্রতিষ্ঠানকে। অভিযোগ উঠেছে, এতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় দাঁড়াতে পারে প্রায় ২০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি প্রথম চালু হয় ২০০১ সালে, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সহযোগিতায়। ২০১০ সাল পর্যন্ত তা চলমান ছিল। এরপর ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় এ কার্যক্রম চালু থাকে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকার পর সরকার নতুন করে এটি পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রকল্প শুরুর আগেই টেন্ডার-অস্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক বিলম্ব পুরো উদ্যোগটিকে বিতর্কিত করে তুলেছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া এ প্রকল্পটি জুলাই মাসে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২৫ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করার পর এখনো সম্পূর্ণ মূল্যায়ন শেষ হয়নি। দরপত্র নিয়ে অস্বচ্ছতা ও সংকটের কারণে এখনো প্রকল্পের মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হয়নি, ফলে নির্ধারিত সময় শেষেও পার হয়েছে তিন মাস।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম করে কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে কাজ করছে একশ্রেণির কর্মকর্তা। সূত্রমতে, সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে শিক্ষার্থীদের বনরুটি, সিদ্ধ ডিম, ইউএইচটি দুধ, ফর্টিফাইড বিস্কুট ও মৌসুমি ফল দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে শুধু বিস্কুট সরবরাহের টেন্ডারেই এ অনিয়মের অভিযোগ সবচেয়ে প্রকট।
দরপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগের জন্য সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান ছিল মাসাফি ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ইন্ডাস্ট্রিজ ৪০ কোটি ৬৪ লাখ টাকায়। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানি ৪৫ কোটি ৪০ লাখ, তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানি ৪৬ কোটি ২৩ লাখ, আর চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানির দর ৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে চতুর্থ দরদাতা কোম্পানিকে। ফলে শুধু ঢাকা বিভাগেই সরকারের বাড়তি ব্যয় হবে প্রায় ৬ কোটি টাকা, আর সারা দেশে মিলিয়ে ব্যয় বাড়বে প্রায় ২০ কোটি টাকা।
একই ধরনের পরিস্থিতি চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রংপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগেও দেখা গেছে।
মাসাফি ব্র্যান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল এইচ চৌধুরী বলেন, আমরা সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েও বাদ পড়েছি। কেন বা কী কারণে বাদ দেওয়া হলো, তা এখনো জানানো হয়নি। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার এক মাস পর হঠাৎ অন্য প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। অথচ আমরা এ প্রকল্পে দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে কাজ করেছি।
একইভাবে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানি ব্লসম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের এজিএম সাইদুর রহমান বলেন, সাধারণত সর্বনিম্ন প্রতিষ্ঠান বাদ পড়লে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু এবার কোনো রেসপন্সই পাইনি। এতে অনিয়ম ও প্রভাব খাটানোর আশঙ্কা স্পষ্ট।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেন, মিড ডে মিলের টেন্ডার প্রক্রিয়া এখনো চলমান। অনিয়মের বিষয়ে আমি কিছু জানি না, ইভ্যালুয়েশন কমিটি পুরো প্রক্রিয়া দেখছে।
স্কুল ফিডিং প্রকল্পের পরিচালক ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, টেন্ডারে কোনো অনিয়ম হয়নি। যেসব প্রতিষ্ঠান টেকনিক্যালি নন-রেসপন্সিভ ছিল, তারা বাদ গেছে। প্রকল্পটি শুরু করা হবে। এরই মধ্যে বিস্কুট ও দুধের টেন্ডারের কাজ শেষ হয়েছে, বাকিগুলোর মূল্যায়ন চলছে।
এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় দেশের আট বিভাগের ১৫০টি উপজেলার প্রায় ৩১ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থী এখনো তাদের নির্ধারিত ‘মিড ডে মিল’ পাচ্ছে না। এতে তাদের পুষ্টি, মনোযোগ ও শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, শিশুদের পুষ্টি ও শিক্ষার মতো মানবিক উদ্যোগে অনিয়মের ছায়া পড়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তারা মনে করেন, দ্রুত তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে শুধু টাকার অপচয় নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও পুষ্টি নিরাপত্তা।
এ বিষয়ে পুষ্টিবিদ এসআইবিএল ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এবং নিউরোজেন হেলথ কেয়ারের পুষ্টিবিদ নাঈমা রুবী বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুদের দুপুরের খাওয়ার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে স্কুল ফিডিং প্রকল্পটি বাচ্চাদের পুষ্টির ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।
মন্তব্য করুন