

কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেয় ছয়জন। তাদের হাতে ছিল স্বয়ংক্রিয় নাইন এমএম পিস্তল। গুলি চালায় চারজন। রাজধানীর পল্লবী যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার মিশনে সব মিলিয়ে ১৮ রাউন্ড গুলি খরচ করে শুটাররা। এরপর ঘটনাস্থল থেকে মোটরবাইকে পালিয়ে যায়। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া ছয়জনের মধ্যে জনি ভূঁইয়া নামে একজনকে আটক করে স্থানীয় জনতা। তার দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে জনিসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে এবং সাত-আটজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে গতকাল পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন কিবরিয়ার স্ত্রী সাবিহা আক্তার দিনা। পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছেন, নাম আসা সবাই পল্লবীর চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ ও ভাড়াটে খুনি। যুবদলের পল্লবী থানা কমিটি ও স্থানীয় একটি গার্মেন্টসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয়েছেন গোলাম কিবরিয়া।
গতকাল সন্ধ্যায় মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান।
গত সোমবার সন্ধ্যায় পল্লবী ১২ নম্বর সেকশনের বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারি দোকানে বসে থাকা অবস্থায় থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়ার বুকে, পিঠে, মুখে ও ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে তিনজন মুখোশধারী। গুলির পরে সেই দোকানের মেঝেতেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই কিলিং মিশনে অংশ নেয় জনি ভূঁইয়া, সোহেল ওরফে পাতা সোহেল, মাসুম ওরফে ভাগিনা মাসুম, সোহাগ ওরফে কাল্লু এবং রোকন ও অজ্ঞাতনামা আরও একজন।
গতকাল দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, সেই দোকানটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং স্থানীয়রা বেশ আতঙ্কিত। স্থানীয় বাসিন্দা ও ঘটনার ছয়জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনি ভূঁইয়া, সোহাগ ওরফে কাল্লু ও রোকন দোকানে ঢুকে গুলি চালায়। এই তিনজন দোকানে ঢোকার আগে থেকেই সেখানে ওয়াচারের ভূমিকায় ছিল পাতা সোহেল ওরফে মনির এবং মাসুম ওরফে ভাগিনা মাসুমসহ তিনজন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, একদম কাছ থেকে গুলি করায় কিবরিয়ার চোয়াল, গলার ডান পাশ, বাম কানের পেছনে, ঘাড়ের পেছনে, বুকের ডান ও বাম পাশ, ডান হাতের বাহু, বাম হাতের কুনই ও বাম হাতের কবজি ঝাঁজরা হয়ে যায়। একেবারে মৃত্যু নিশ্চিত করে শুটাররা স্থান ত্যাগ করে।
বাইকে উঠতে না পেরে ধরা পড়ে জনি: প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুটাররা কিবরিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করে বাইরে বেরিয়ে আসে। এরপর আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকা দুটি বাইকে করে পালিয়ে যায় তারা। এই সময় বাইকে উঠতে পারেনি জনি। তখন স্থানীয় জনতা তাকে ধাওয়া দেয়। তখন এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে উদ্যত হয় জনি। এক রাউন্ড গুলিও ছোড়ে। এই গুলি গিয়ে লাগে একজন রিকশাচালকের শরীরে। তাকেও উদ্ধার করে নেওয়া হয় হাসপাতালে। তবে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেন, বাইকে উঠতে না পেরে জনি রিকশায় উঠে বসে রিকশাচালককে দ্রুত চালানোর জন্য চাপ দেয়। সেই রিকশাওয়ালা কথা না শুনলে তাকে গুলি করে জনি।
স্থানীয়রা বলছেন, কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া সবাই বিদেশ পলাতক মিরপুরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী মামুনের লোক। নাম আসা পাঁচজনই মিরপুর, পল্লবী, বাউনিয়া বাঁধসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও নানা অপকর্মে লিপ্ত। এর আগে গত বছরের ৩০ অক্টোবর পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় একদল সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি গুলিতে আয়েশা (৩৫) নামে এক নারী নিহত হন। প্রতিপক্ষ মাদক কারবারিদের দিকে ছোড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তিনতলায় নিজের ঘরে থাকা ওই নারীর মাথায় লাগে। সেখানেও নাম এসেছিল জনি, মামুনসহ অন্যদের।
হত্যার নেপথ্যে কী: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামুনের সঙ্গে গার্মেন্টস ও যুবদলের কমিটি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় কিবরিয়ার। ১০-১২ দিন আগে থেকে মামুন পল্লবী থানা যুবদলের কমিটিতে তার লোকজনকে পদ দিতে ও মিরপুর-৭ নম্বরের ডেকো গার্মেন্টসের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। এসব নিয়েই তাদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এরই জেরে খুন হয়েছেন যুবদল নেতা কিবরিয়া। গতকাল পল্লবীতে কিবরিয়ার বাড়ির সামনে কথা হয় আমান নামে তার এক রাজনৈতিক সহচরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যারা হত্যা করেছে তারা এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারি। ভাই বেশকিছু দিন থেকে এলাকায় মাদক নির্মূল করতে কাজ করছিলেন। এটাই তার জীবনের কাল হলো।’ সেখানেই কথা হয় কিবরিয়ার ছোট ভাই গোলাম কবিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই এলাকার সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। এলাকায় তার বেশ পরিচিতি। এই পরিচিতিও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য হত্যার পেছনে কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তদন্তে বিষয়গুলো দ্রুতই বেরিয়ে আসবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি মিরপুর বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘হত্যার নেপথ্যের কারণ হিসেবে আমরা বেশ কয়েকটি বিষয় জেনেছি। যাচাই না করে তো সেগুলো বলা যাচ্ছে না। আর যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারেও আমরা তদন্ত শেষ না হলে কিছু বলতে পারব না।’
গতকাল বিকেলে নিহত গোলাম কিবরিয়ার জানাজা হয় স্থানীয় ঈদগাহ ময়দানে। জানাজায় অংশ নেন তার দলীয় রাজনৈতিক সহচরসহ অন্যান্য দলের নেতারা। জানাজা শেষে কালশী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এদিকে কিবরিয়াকে হত্যার ঘটনায় তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কালবেলার মতলব প্রতিনিধি জানান, গোলাম কিবরিয়া একসময় জাতীয় দলের ফুটবলার ছিলেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আলী। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে দুই ভাই ইউরোপে বসবাস করেন। কিবরিয়া দুই কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন। নিহতের খালাতো ভাই মো. পারভেজ বলেন, ‘আমার ভাই খুব ভালো মানুষ ছিল। গত বছর বাড়িতে এসেছিল। সে একসময় ভালো ফুটবলার ছিল। বিএনপি করার কারণেই কয়েকবার জেল খাটতে হয়েছে। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
ওলীপুর গ্রামের বাসিন্দা ও মতলব উত্তর উপজেলা বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল হাসান বেনু বলেন, ‘কিবরিয়া ভাই তার ছোট ভাই কবির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে মাঝেমধ্যে গ্রামে আসতেন। তিনি ভালো মানুষ। তার মতো মানুষকে কীভাবে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো, তা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা জড়িত তাদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানাই।’
মন্তব্য করুন