

রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেলের খুঁটি ও উড়ালপথের মাঝে থাকা বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে পথচারী যুবক প্রাণ হারানোর ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়। ওই সময় নিহত যুবকের ওপর পড়া বিয়ারিং প্যাডটির সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু একই দিন মেট্রোরেলের খুঁটি থেকে আরেকটি বিয়ারিং প্যাড ছিটকে পড়ে। সেই ঘটনা অনেকটাই ‘চাপা’ পড়ে যায়। খুঁটি থেকে পড়া দ্বিতীয় বিয়ারিং প্যাডের সন্ধান এখনো মেলেনি। দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গঠিত কমিটি এই বিষয়টি নিয়েও কাজ করছে। যদিও দ্বিতীয়বারের মতো মেট্রোর খুঁটি থেকে বিয়ারিং প্যাড কেন খসে পড়ল, মোটাদাগে এর কোনো কারণ এখনো খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি।
ফার্মগেট এলাকায় আলোচিত এ দুর্ঘটনা ঘটে গত ২৬ অক্টোবর। দুর্ঘটনার পর খুলে পড়া বিয়ারিং প্যাডটি পুনঃস্থাপন করতে গিয়ে দেখা যায়, একই খুঁটিতে থাকা অন্য আরেকটি বিয়ারিং প্যাড নির্ধারিত জায়গায় নেই। এ ঘটনায় মেট্রো কর্তৃপক্ষ রীতিমতো বিস্মিত। সাধারণত একটি খুঁটির দুই পাশে দুটি উড়ালপথের অংশ যুক্ত হয়েছে। প্রতিটি খুঁটির দুই পাশে দুটি করে চারটি বিয়ারিং প্যাড রয়েছে। খুঁটি থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ার ঘটনা দৃশ্যমান হলেও অন্য আরেকটি বিয়ারিং প্যাড কোথায় গেল! এ বিষয়ে জানেন না মেট্রো কর্তৃপক্ষের কেউই। যদিও পরে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দুটি বিয়ারিং প্যাড একসঙ্গে পড়তে দেখা যায়। কিন্তু দ্বিতীয় সেই প্যাডটির সন্ধান মেলেনি গতকাল পর্যন্ত।
ওই দুর্ঘটনার পর কারণ খুঁজতে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও এরপর আরও দুই দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবু কেন দুর্ঘটনা ঘটল, সেই কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি কমিটি। সর্বশেষ আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই কমিটিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফকে। তিনি এই দায়িত্বে আসার আগে ঢাকায় মেট্রোরেল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম, ডিএমটিসিএলের লাইন-৫-এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। উপসচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তদন্ত কমিটি ও ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ—এ দুই পক্ষই ‘উধাও’ হওয়া বিয়ারিং প্যাড ও দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে ব্যস্ত। সবশেষ গতকাল বুধবার তদন্ত কমিটির সদস্যদের আরেক দফা বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকে প্রতিবেদন জমার চূড়ান্ত মীমাংসা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ‘পছন্দের’ সম্ভাব্য চার কারণ ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্ত। মেট্রোরেলের নকশায় কোনো ত্রুটি আছে কি না—এই অবকাঠামো নির্মাণের সময় বড় ধরনের কোনো অব্যবস্থাপনা হয়েছিল কি না, নির্মাণ সামগ্রী ও নির্মাণের ধরনে কোনো সমস্যা রয়েছে কি না এবং মেট্রোপথের খুঁটিতে যেসব বিয়ারিং প্যাড ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো মানসম্মত কি না—এই চার প্রশ্নের উত্তরে বেশি মনোযোগী কমিটি।
আর উধাও হওয়া বিয়ারিং প্যাড প্রসঙ্গে জানা যায়, খুঁটি থেকে দুটি বিয়ারিং প্যাড একই সময় পড়েছে। খুঁটির পূর্বাংশের উত্তর ও দক্ষিণ দুই পাশের দুটি বিয়ারিং প্যাড পড়ে যায়। এর মধ্যে উত্তর পাশের বিয়ারিং প্যাডটি দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু দক্ষিণ পাশের বিয়ারিং প্যাডটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই বিয়ারিং প্যাড কোথায় গেল, এর উত্তর এখনো নিরুদ্দেশ। এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ডিএমটিসিএলকে কোনো তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ।
একদিকে তদন্তের সময় পেছানো, অন্যদিকে বিয়ারিং প্যাড ‘উধাও’ হওয়ার ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন করতে না পারায় রাজধানীবাসীর কাছে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন আরও বাড়ছে। যদিও তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার। আর মেট্রো পথের নিরাপত্তা নিরীক্ষা (সেফটি অডিট) করাতে বিদেশ থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল আনানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এক বছরের ব্যবধানে ঢাকার মেট্রোরেলে একই ধরনের দুর্ঘটনা দুবার ঘটেছে। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল।
দ্বিতীয়বারের দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, ওই ঘটনাটা নাশকতা, নাকি নির্মাণত্রুটির কারণে হয়েছে, তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে কমিটি প্রতিবেদন দেবে।
কথা হলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে দুই সপ্তাহ সময়টা আসলে কম। তাই সময় বাড়ানো হয়েছে। আশা করছি, এই সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণের কোনোটিই এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। একটা কারণের ওপর আরেকটা নির্ভর করে। তাই কোনো কিছুই পরিষ্কার হচ্ছে না। তবে আমাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই যে, নিজেদের চাওয়া বাস্তবায়ন করতে মনগড়া একটা তদন্ত করব। আমরা চাই আসল কারণ বের হয়ে আসুক’।
শেখ মইনউদ্দিন বলেন, ‘গুণগত মান যাচাই করতে এবং নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে পড়ে যাওয়া বিয়ারিং প্যাডটি বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। সেখান থেকে একটা ফল জানা যাবে। আর তদন্ত কমিটিতে বিদেশি কাউকে নিয়োগ দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নেই। তবে তদন্ত শেষে বিদেশ থেকে একটি এক্সপার্ট টিম (বিশেষজ্ঞ দল) এনে পুরো মেট্রোরেলের সেফটি অডিট করানো হবে। কারণ, চালু করার আগে মেট্রোর সেফটি অডিট করা হয়নি।’
মূলত, বিয়ারিং প্যাড হচ্ছে রাবার ও ইস্পাতের মিশ্রণে তৈরি আয়তাকার এক ধরনের প্যাড, যা অনেকটা বিছানার ম্যাট্রেসের মতো করে ব্যবহৃত হয়। মেট্রোরেলের উড়ালপথটিকে বলা হয় ভায়াডাক্ট। এর ওপরই রেললাইনসহ যাবতীয় স্থাপনা বসানো হয়। আবার ভায়াডাক্ট বসানো হয় স্তম্ভ বা পিলারের ওপর। এই স্তম্ভকে প্রকৌশলের ভাষায় বলা হয় পিয়ার। মেট্রোরেলের উড়ালপথটি কংক্রিটের তৈরি, যা ৩০ থেকে ৪০ মিটার লম্বা একেকটি স্প্যান জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যেহেতু ভায়াডাক্ট ও পিয়ার দুটিই কংক্রিটের তৈরি, তাই দুটি কংক্রিটের বস্তুর একটির ওপর আরেকটি স্থাপন করলে ঘর্ষণজনিত সমস্যা হতে পারে। হতে পারে ক্ষয়, ঘটতে পারে স্থানচ্যুতিও। এ জন্যই ভায়াডাক্ট ও পিলারের মাঝখানে রাবার ও স্টিলের তৈরি বিয়ারিং প্যাড দেওয়া হয়, যা স্থাপনাটির সুরক্ষায় কাজ করে।
এক প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কমিটির প্রধান ও সেতু বিভাগ সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ কালবেলাকে বলেন, ‘নিখোঁজ প্যাডের সন্ধান পেতেও আমরা কাজ করছি। এখন এটা পুলিশি বিষয়। তবে সিসিটিভিতে দুটি বিয়ারিং প্যাড একসঙ্গে পড়তে দেখা গেছে। সেটি খোঁজা হচ্ছে। আর জটিলতা থাকায় কিছু জায়গায় দুর্ঘটনার কারণ খোঁজার তদন্ত আটকে আছে। এখনই কোনো কিছু সুনির্দিষ্ট করে বলার সুযোগ নেই। কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। নকশা, নির্মাণ, প্যাডের মান; এগুলো বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, চলতি সপ্তাহে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে।’
মন্তব্য করুন