

একসময় গ্রামবাংলার মাঠে-ঘাটে পানি সেচের মূল ভরসা ছিল দোন-সেঁউতি। আদিম এ সেচযন্ত্রের মাধ্যমে ফসলি জমিতে পানি তোলার দৃশ্য ছিল গ্রামবাংলার এক চিরচেনা রূপ।
তবে সময়ের ব্যবধানে আর যুগের পরিবর্তন ও কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষের ধারায় গ্রামীণ সেই ঐতিহ্যবাহী সেচযন্ত্র দোন-সেঁউতি এখন বিলুপ্তির পথে।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এক সময় যেসব খাল, জলাশয়, বিল ও পুকুরের পাড়ে কৃষকরা দোন-সেঁউতি চালাতেন সেসব স্থানে এখন শোভা পাচ্ছে ডিপ-টিউবওয়েল, মোটরচালিত পাম্প ও আধুনিক সেচ ব্যবস্থা। ফলে প্রাচীন এই সেচযন্ত্রটির ব্যবহার কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে পৌঁছেছে। যার ফলে গ্রামীণ কৃষি থেকে প্রাচীন সেচযন্ত্র দোন-সেঁউতি বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে।
স্থানীয় কৃষক ও সচেতন মহলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামীণ কারিগর ও কৃষকরাই বাঁশের বেত, দড়ি ও কাঠ দিয়ে এই বিশেষ সেচযন্ত্র দোন-সেঁউতি তৈরি করতেন। চার টুকরো দড়িতে দুজন মানুষের সমন্বয়ে দোন-সেঁউতি দিয়ে পানি সেচের কাজ করা হতো। ফসলি জমিতে পানি তোলার ক্ষেত্রে এটি ছিল পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী।
দোন-সেঁউতি ব্যবহারে সময় ও শ্রম বেশি লাগলেও এতে খরচ হতো না বললেই চলে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং দ্রুত সেচ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কারণে পুরোনো পদ্ধতিটি বাঙালি সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে শ্রম ও সময় বাঁচলেও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, দোন-সেঁউতি শুধু সেচযন্ত্রই ছিল না, এটি ছিল নিয়মিত কৃষিকাজের একটি শ্রমঘন সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। পানি তোলার সেই কর্মব্যস্ততা ও মিলেমিশে কাজ করার স্মৃতি আজও তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। নতুন প্রজন্মের কাছে এটি এখন কেবল ইতিহাস ও বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। উদ্যোগ নিয়ে দোন-সেঁউতিকে গ্রামীণ ঐতিজয়ের অংশ হিসেবে সংরক্ষণ করা সম্ভব। স্কুল কলেজে প্রদর্শনী কৃষি মেলায় প্রদর্শন বা স্থানীয় পর্যায়ে গবেষণার মাধ্যমে এই ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করা গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে বাংলাদেশের প্রাচীন কৃষি ঐতিহ্য।
সেকান্দর আলী নামের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, ‘আমরার আমলে ক্ষেতে পানি দেওনের লাইগ্যা এত যন্ত্রপাতি আছিল না। হেলবা আমরা বাঁশের বেত দিয়া হেউত (দোন-সেঁউতি) বানাইয়া এইডা দিয়া ক্ষেতে পানি দিতাম। অহন দেহি কতরহমের মেশিন বাইর অইছে। হেউত (দোন-সেঁউতি) এললাইগ্যা অহন আর চোহে দেহি না। অহন মাইনষে মেশিন দিয়াই ক্ষেতে পানি দেয়।’
সাবেক প্রধান শিক্ষক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আধুনিকতার ঢেউয়ে হারিয়ে যেতে বসা এই বাঙালি ঐতিহ্যের প্রাচীন সেচযন্ত্র এখন অতীত স্মৃতির সাক্ষী। এই ঐতিহ্যবাহী সেচযন্ত্রটি সময়ের গর্ভে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায়। এখনো বছরের কোনো কোনো সময় হঠাৎ করেই কোথাও কোথাও দোন-সেঁউতির ব্যবহার চোখে পড়ে, তখন বাঙালি মন জেগে ওঠে এবং ফিরে যায় ফেলে আসা অতীতে।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, দোন-সেঁউতি একটি প্রাচীন সেচযন্ত্র। এটির মাধ্যমে একসময় কৃষকরা ফসলি জমিতে পানি সেচ দিতেন। একসময় এ সেচযন্ত্রটি কৃষি কাজে বহুল প্রচলন ছিল। তবে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এই প্রাচীন সেচযন্ত্রটির ব্যবহার কমে গেছে। তবে আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ফসল উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
মন্তব্য করুন