গত দুদিনে রাজধানীসহ সারা দেশে দেশি ও আমদানি পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর পেছনে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণাকে কাজে লাগিয়েছে এ খাতের সিন্ডিকেট। চক্রটি দেশের সব পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ১০০ টাকার পেঁয়াজ ২০০ টাকায় বিক্রি করছে।
বাজারে হঠাৎ পেঁয়াজের সংকট ও দাম বাড়ার বিষয়ে রাজধানীর শ্যামবাজার, কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ীর পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ফরিদপুর ও পাবনা অঞ্চলের ব্যাপারীরা পেঁয়াজ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এ জন্য বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, দেশের প্রায় সব অঞ্চলে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ওঠা শুরু হয়েছে। বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন সময় লাগবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু হয়েছে। সূত্র বলছে, দেশে প্রতিবছর মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে এবং উৎপাদন হয় প্রায় ৮ লাখ টন। এ ছাড়া এ বছর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হবে প্রায় ৫০ হাজার টন। এই মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন নতুন পেঁয়াজ ক্ষেত থেকে তোলা ও বাজারে আসা শুরু হয়েছে এবং বাজারে থাকবে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সূত্র বলছে, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও ইতোমধ্যে দেশটি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া নুতন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসায় আমদানি ঘাটতি মেটানো সম্ভব। ফলে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
এদিকে পেঁয়াজের দাম রাতারাতি দ্বিগুণ হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনা চললেও স্বস্তি ফেরেনি অন্যান্য নিত্যপণ্যে। শীতকালীন সবজির দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে এলেও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আলু, চিনি, ডাল ও ভোজ্যতেল। গত আগস্টে চিনির কেজি ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। উল্টো দাম বাড়িয়ে চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। সংকট না থাকলেও নির্ধারিত ৩৫ টাকার আলু বেক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে। পাশাপাশি মাসের ব্যবধানে মানভেদে মসুর ডালের কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ১১০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে টাকার বিপরীতে ডলার মূল্য বৃদ্ধিকে ইস্যু করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বিপণনকারী সমিতি। বোতলজাত সয়াবিন তেলের ১ লিটারে ৩ টাকা বেড়ে ১৫৮ টাকা এবং ৫ লিটারের বোতলে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে ৭৯০ থেকে ৮২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজার পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। অপরদিকে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংকটের প্রকৃত কারণ সমাধান না করে তদারকির নামে প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থা তাদের হয়রানি ও জরিমানা করছে।
গতকাল সারা দেশে বাজার তদারকিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ৪৩টি টিম একযোগে অভিযানে নামে। এ সময় পেঁয়াজের মূল্য কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে।
এদিকে গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ পেঁয়াজের দাম রাতারাতি দ্বিগুণ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, দাম বাড়তে তো সময় লাগার কথা। কিন্তু কিছু বাড়তি লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা কোনো নৈতিকতাই রাখলেন না। ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করল, আর দেশে এক দিনের ব্যবধানে পণ্যটির দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেল, এটা ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল আচরণ নয়।
বাজার সিন্ডিকেট, অতি মুনাফালোভী এবং বাজার কারসাজির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে দাবি করে এদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেছে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজ নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার সিন্ডিকেট করে মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং লুটে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী এবং দেশদ্রোহী।
এদিকে বাজারে চড়া দামে পেঁয়াজ বিক্রি, মজুত ও কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হুঁশিয়ার দিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল চকবাজার ও শ্যামবাজার এলাকায় মাঠে নেমেছে। তিনি বলেন, কেউ যদি কালোবাজারি করে, পেঁয়াজ মজুত করে এবং বেশি দামে বিক্রির পাঁয়তারা করে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব।