জাকির হোসেন লিটন
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৪, ০২:২৯ এএম
আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৪, ১০:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্থানীয় সরকারের ভোটেও কমছে ভোটারের আগ্রহ

ভোট পর্যালোচনা
স্থানীয় সরকারের ভোটেও কমছে ভোটারের আগ্রহ

জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারের ভোটেও সাধারণ মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাজনৈতিক দলের বর্জন, দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সরকারদলীয় একাধিক প্রার্থীর সমর্থকদের সহিংসতা, ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তার, ফলাফলে আস্থাহীনতাসহ নানা কারণে ভোটবিমুখ হয়ে পড়ছেন নাগরিকরা। ভোটারদের মধ্যে তৈরি হওয়া এই প্রবণতাকে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতি উত্তরণে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

গত শনিবার ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে সাধারণ ও কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের ২৩১টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ময়মনসিংহের ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩৯ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। এ সিটিতে ভোট প্রদানের হার ৫৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। তার আগে ২০১৯ সালে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইকরামুল হক টিটু মেয়র নির্বাচিত হন।

অন্যদিকে কুমিল্লা সিটিতে ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ ভোটারের মধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন মাত্র ৯৪ হাজার ১১৫ জন। ভোটের হার ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২ সালের কুমিল্লায় ভোট পড়েছিল ৫৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৫৪ দশমিক ৯ শতাংশ। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচনে ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় নির্বাচনে ৬১ দশমিক ১ শতাংশ, ১৯৮৮ চতুর্থ জাতীয় নির্বাচনে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (একতরফা) ২১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে ৭৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় নির্বাচনে ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ, ২০১৪ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৩৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৮০ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পড়ে। সরকারবিরোধীদের বর্জনের মুখে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই ভোটবিমুখ হওয়া শুরু হয় নাগরিকদের। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধীদের বর্জনের মুখে ওই বছর ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন, যা নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার।

এরপর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নানা আশ্বাসের পর বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু ওই নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগের রাতে কোনো কোনো এলাকায় ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ভরে রাখার অভিযোগ ওঠে। এসব কারণে ভোটারদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। জাতীয় সংসদ ছাড়াও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা যায়। বিরোধীদের বর্জনের মুখে সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল মনোনীত প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শন এবং অনেক জায়গায় ফলাফলে প্রভাব বিস্তারের কারণে দিন দিন আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে ভোটারদের মধ্যে। গত পাঁচ বছরে স্থানীয় সরকার ও সংসদের বিভিন্ন উপনির্বাচনে ২০ শতাংশের কম ভোট পড়তেও দেখা গেছে। সরকারবিরোধীদের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হার ছিল মাত্র ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও ভোটের এ হার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচনের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎসবমুখর ভোটের জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ ছাড়া কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও থাকা আবশ্যক। পছন্দের দল এবং শক্ত প্রার্থী না থাকলে ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না। ২০১৮ সালের অংশগ্রহণমূলক একাদশ জাতীয় সংসদের সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ভোটের হারের তুলনায় সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, অতীতে জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। গত শনিবার অনুষ্ঠিত দুই সিটিসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ২৩১টি নির্বাচনের চিত্রে সেটি ফুটে উঠেছে। জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় এসব নির্বাচনও বিরোধী দলগুলো বর্জন করেছিল।

এর আগে একাদশ সংসদের গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখে খানিকটা হতাশ হয় নির্বাচন কমিশন। পরে নানা অনিয়মের অভিযোগে ওই ভোট বাতিল করে সব কেন্দ্রে ফের ভোট গ্রহণ করা হয়। পরে দ্বিতীয়বার অনুষ্ঠিত হওয়া ওই নির্বাচনেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পড়ে। বিগত সংসদে বিএনপি এমপিদের ছেড়ে দেওয়া ৬ আসনের উপনির্বাচনেও হতাশাজনক ভোটার উপস্থিতি নজর কাড়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের। এসব নির্বাচনেও গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানায় নির্বাচন কমিশন। এর আগে করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। ওই নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। তারও আগে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইভিএমের ব্যাপক প্রচারের মধ্যে ভোটারের খরা দেখেছিল ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে। সেবার দক্ষিণ সিটিতে ২৯ শতাংশ ও উত্তরে ভোটের হার ছিল ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

ভোটারের মধ্যে ভোটবিমুখ এই প্রবণতা সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘ভোটার উপস্থিতি নির্ভর করছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। একতরফা ভোটের কারণে ভোটের প্রতি দিন দিন মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। এ ধারা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে। এটি রাজনীতিকদেরই সমাধান করা উচিত।’

নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম কালবেলাকে বলেন, ‘ভোটাররা ভোটে আগ্রহ হারালে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। ভোটার ছাড়া ভোটকে লেজিটিমেট বলা যায় না। সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলে ভোটে মানুষের আগ্রহ কমে যায়। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন তথা আয়োজকরা যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের নিশ্চয়তা এবং প্রশাসন ভোটের পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিধান না করে, তাহলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে চায় না। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে নির্বাচন কমিশনেরও দায় থাকে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২০১৮ সালের নির্বাচনের বদনাম ঘোচাতে চায় পুলিশ : ডিএমপি কমিশনার

ওয়েস্ট হ্যামের বিরুদ্ধে চেলসির বড় জয়

নরসিংদী জেলা সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা’র নতুন কমিটিকে সংবর্ধনা

কেইনের হ্যাটট্রিকে লেইপজিগকে উড়িয়ে দিল বায়ার্ন

নিখোঁজের একদিন পর যুবকের মরদেহ মিলল পুকুরে

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের তারিখ ঘোষণা করলেন ট্রাম্প

এশিয়া কাপ দলে জায়গা পেয়ে সোহানের কৃতজ্ঞতার বার্তা

ঘুষ কেলেঙ্কারিতে পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

প্রবীণদের বিশেষ যত্ন নিয়ে বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিন: স্বাস্থ্য সচিব

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

১০

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

১১

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

১২

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

১৩

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

১৪

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

১৫

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

১৬

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

১৭

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

১৮

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১৯

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

২০
X