কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের স্টেটসউইম্যান

জাকির হোসেন
ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স।
ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স।

খালেদা জিয়া স্বভাবে ও অবস্থানে বিদ্রোহী নন। তিনি সংবেদনশীল মানুষ, তবে সাহসী। এ সাহসের ওপর ভর করেই তিনি রাজনীতির জটিল পথে এগিয়ে এসেছেন, পেছাননি। অবিরাম এগিয়ে গেছেন বাংলাদেশের রক্তাক্ত রাজনীতির পথে। বেগম জিয়া যে শুধু সাহসী তা নয়, পরিশ্রমীও। দল, সরকার এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিরন্তর পরিশ্রম করেছেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে তিনি দিনভর ছুটে বেড়িয়েছেন পথ থেকে পথে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। নেতা হিসেবে বেগম জিয়া অত্যন্ত ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু, সংযমী, আপসহীন ও স্পষ্টভাষী

স্টেটসউইম্যান শব্দটি ব্রিটিশ গণমাধ্যমের সৃষ্টি। কথিত আছে, বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে সিরিমাভো বন্দরনায়েকে তৎকালীন সিলনের (শ্রীলঙ্কা) প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ব্রিটিশ গণমাধ্যমে ‘স্টেটসম্যান’ শব্দের বিকল্প হিসেবে স্টেটসউইম্যান শব্দটি ব্যবহার করে। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান। রাজনীতিতে তিনি আসতে চাননি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতিও তার ছিল না কোনো মোহ। বিগত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে বিশ্বরাজনীতিতে হত্যা, ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের যে ধারা বিদ্যমান ছিল, সেই রক্তাক্ত পথ ধরে তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। নিয়তি তাকে রাজপথে নিয়ে আসে আর ক্ষমতা খুঁজে নিয়েছিল তাকে।

স্বামী, সন্তান আর সংসারের মধ্যেই বেগম জিয়া নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে বিপথগামী কিছু সামরিক কর্মকর্তা কর্তৃক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তবু তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হননি, নিজেকে রেখেছিলেন রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর সরকার এবং দলের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দ্রুত সরকারের পতন হয় এবং দল ভাঙনের মুখে পড়ে। এমন একটি সংকটময় মুহূর্তে বেগম জিয়া নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি পূর্বনির্ধারিত বৃত্তে। কর্তব্যবোধের টানে সক্রিয় হন রাজনীতিতে। হাল ধরেন তার স্বামীর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি)। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিশৃঙ্খল দলকে সংগঠিত করেন। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি আপসহীন ভূমিকা পালন করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তিনি তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবেও। কেননা, রাজনীতির পথ সবসময় সমান্তরাল নয়। এখানে উত্থান ও পতন অনিবার্য। রাজনৈতিক জীবনে ব্যর্থতা আসে, আসে অবসাদ, ক্লান্তি, হতাশা ও নিঃসঙ্গতা। বেগম জিয়ার জীবনেও এসব এসেছে। অনেক রকম বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু কখনো দমে যাননি, আত্মসমর্পণ করেননি। সকল প্রকার বাধা, বিপত্তি, সংকট, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে এগিয়েছেন দৃঢ়চিত্তে। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ছিল তার জীবন। পাঁচ দশকেরও বেশি সময়সীমায় বাংলাদেশের জীবনে যেসব ধারা ও প্রবণতা কার্যকর ছিল, অবস্থান ছিল যেসব চড়াই-উতরাইয়ের, উদ্যোগ ও আকাঙ্ক্ষার, এসবের অনেকগুলোই স্পর্শ করেছে তার জীবনকে।

খালেদা জিয়া স্বভাবে ও অবস্থানে বিদ্রোহী নন। তিনি সংবেদনশীল মানুষ, তবে সাহসী। এ সাহসের ওপর ভর করেই তিনি রাজনীতির জটিল পথে এগিয়ে এসেছেন, পেছাননি। অবিরাম এগিয়ে গেছেন বাংলাদেশের রক্তাক্ত রাজনীতির পথে। বেগম জিয়া যে শুধু সাহসী তা নয়, পরিশ্রমীও। দল, সরকার এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিরন্তর পরিশ্রম করেছেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে তিনি দিনভর ছুটে বেড়িয়েছেন পথ থেকে পথে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। নেতা হিসেবে বেগম জিয়া অত্যন্ত ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু, সংযমী, আপসহীন ও স্পষ্টভাষী। স্বভাবে তিনি শান্ত। তার ব্যক্তিগত চরিত্রের এ দুর্বলতা রাজনৈতিক জীবনে কোনো বাধা হতে পারেনি। সবরকম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন অসীম ধৈর্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে। সবসময়ই ভরসা করতেন সততা ও ন্যায়ের ওপর। কর্তব্যনিষ্ঠা ও দৃঢ়তাই যে পারে সব বৈরিতার গণ্ডিকে অতিক্রম করতে, নেতা হিসেবে তিনি এ উদাহরণ আমাদের সামনে রেখেছেন।

১৯৮১ সালের ৩০ মে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হলে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের আহ্বানে বেগম জিয়া ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বেই মূলত বিএনপির পূর্ণ বিকাশ হয়। বিএনপিকে তিনি প্রায় চার দশক নেতৃত্ব দিয়েছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেকে বাংলাদেশে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

খালেদা জিয়া আধুনিক বিশ্বের ১৬তম নারী সরকারপ্রধান। এখানে বলা প্রয়োজন, ইউরোপ কিংবা আমেরিকা নয়, আধুনিক বিশ্বে নারীর রাজনৈতিক জয়যাত্রা শুরু আমাদের এই মহাদেশ থেকেই। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে সিরিমাভো বন্দরনায়েকের দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র সিলনের (শ্রীলঙ্কার) প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম নারী সরকারপ্রধান হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এরপর ষাটের দশকের মাঝামাঝি ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি আধুনিক বিশ্বের দ্বিতীয় নারী সরকারপ্রধান। বিশ্বের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হলেন আর্জেন্টিনার ইসাবেল ডি পেরন। তিনি দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার স্বামী জোয়ান পেরন হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হন। তবে বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্ট হলেন আইসল্যান্ডের ভিগদিস ফিনবগিদত্তে। ১৯৮০ সালে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর আরও তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি মোট ১৬ বছর আইসল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম বিশ্বের প্রথম নারী সরকারপ্রধান হলেন বেনজির ভুট্টো। তিনি পাকিস্তানের প্রথম নারী সরকারপ্রধান। ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।

আধুনিক বিশ্বে শতাধিক নারী নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ অনুপ্রেরণাদায়ী নারীরা বিভিন্ন পেশা থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে নাইট ক্লাবের নর্তকী, পুলিশ অফিসার, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক, মনোবিজ্ঞানী, জৈব-রসায়নবিদ, হিসাবরক্ষক, গৃহিণী এমনকি গেরিলা যোদ্ধাও রয়েছেন। সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তারা দেশের বৈরী সময়ে এবং কঠিন পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করেছেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে শান্তিতে রূপান্তর, নারী এবং শিশুর জীবনমানের উন্নয়ন, বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফিলিপাইনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী কোরাজন অ্যাকুইনোর অনেক মিল আছে। কোরাজন অ্যাকুইনো স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছেন ফিলিপাইনের গণতন্ত্রকামী মানুষের হৃদয়ে, স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘জাতির মা’ হিসেবে। তাই নব্বইয়ের গণআন্দোলনে আপসহীন ভূমিকার জন্য ওই সময় আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেগম জিয়াকে অনেকেই কোরাজন অ্যাকুইনো হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মালয়েশিয়ায় দুই বাংলাদেশির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ

হরিণের মাংসসহ আটক ৮

যে বিলাসবহুল নেশায় বছরে ৬০ কোটি টাকারও বেশি খরচ করেন হলান্ড

পাটুরিয়ায় ফেরিঘাটে ভাঙন, ৪ নম্বর ঘাটও ঝুঁকিতে

দুই কারণে বাড়ল জ্বালানি তেলের দাম

ত্বকের যত্নে ম্যাজিকের মতো কাজ করে যে ৫ ফল

আপনি কি জানেন, কেন তালার নীচে ছোট্ট ছিদ্র থাকে?

বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর জর্জিনাকে কত টাকার উপহার দিয়েছেন রোনালদো?

ফ্রিজে রাখা কাটা পেঁয়াজ কি খাওয়া উচিত, যা বলছেন বিশেষজ্ঞ

লুট হওয়া পাথর বালু ও মাটি দিয়ে আড়ালের চেষ্টা

১০

যেসব দেশে থাকার জন্য টাকা পাওয়া যায়

১১

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম এখন কত

১২

ডিএমপিতে অনলাইন জিডি করবেন যেভাবে

১৩

৪ জনের মরদেহ উদ্ধার / ‘আমরা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম সেই ভালো’ লেখা চিরকুটে আরও যা ছিল

১৪

ঝিনাইদহ সাংবাদিক ফোরাম ঢাকার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন 

১৫

পানিবন্দি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খিচুড়ি পৌঁছে দিলেন ইউএনও

১৬

১০৭ বছর বয়সেও চশমা ছাড়া কোরআন পড়েন নুর জাহান

১৭

প্রেম, স্মৃতি আর বিদায়ের গল্পে লিসা-কেনতারো

১৮

গোপালগঞ্জে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মবার্ষিকী পালিত

১৯

আমিরের সঙ্গে দিব্যর স্বপ্নময় মুহূর্ত

২০
X