নাম বাউল জামাল। জামাল নামের আগে-পরে উপাধি বলতে শুধু ‘বাদ্যযন্ত্রী’। কারণ, বেশ কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র মনের মতো করে বাজাতে পারেন তিনি। এই পরিচয় বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ছোটবেলা থেকেই। বাবা ছব্দর আলী বয়াতি নিয়মিত বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে। জামালও জীবনের সঙ্গী বা পেশা হিসেবে বাবার মতোই বেছে নিয়েছেন বাদ্যযন্ত্রকে। তার গান এবং বাদ্যযন্ত্রের হাতেখড়ি বাবার কাছ থেকেই।
আজ ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি বাজিয়ে চলেছেন ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম, খমক, দোতারাসহ আরও কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র। পাশাপাশি বাউল গানও করেন তিনি। জামাল মূলত মাজার কেন্দ্রীয় যন্ত্রবাদক। মনের আনন্দে কয়েক যুগ ধরে তিনি দেশের বিভিন্ন মাজারে দলবল নিয়ে সংগীত পরিবেশন করে আসছেন।
এভাবেই সংগীতের সঙ্গে কেটেছে তার জীবনের কৈশোর ও যৌবনকাল। বয়স হয়েছে। তবে কণ্ঠে এখনো তার তারুণ্যের প্রভাব জীবনে চলার পথে বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন হারিয়ে যাওয়া অনেক বাউল সাধকের গান। সেগুলোর নিজের মতো করে তিনি সুর করেছেন। এই গানগুলো জায়গা-স্থান বিবেচনা ছাড়াই মনের অজান্তে গেয়ে ওঠেন তিনি। এবার বাউল গান নিয়ে মাজারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে চান এই বাউল। এর কারণও আছে অনেক, আছে বিভিন্ন অনেক অভিযোগও।
শুরুতেই জামাল কালবেলাকে বলেন, ‘এই বাউল গান ও বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ৩৫ বছরের বেশি। জীবন-সংসার বলতে গান আর বাদ্যযন্ত্রকেই আমি বুঝি। এই প্রেম-ভালোবাসার টানে কখন যে এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে—বুঝতেও পারিনি। নিজের গান করার পাশাপাশি বিভিন্ন বাউল সাধকদের গান করি। গানগুলো আমার বেঁচে থাকার খোরাক। সেই ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে গান করতাম।
এরপর একা একা দেশের বিভিন্ন মাজারে চলাচল শুরু হয় আমার, যা এখনো চলমান আছে। মাজারে মেলা হয়, সেই মেলায় মন উজাড় করে গান করার যে শান্তি তা কোনো কিছুর বিনিময়েই এভাবে মিলবে না। কিন্তু সেই শান্তি উড়াল দিয়েছে। শুরু হয়েছে যন্ত্রণার জীবন। কারণ ভেঙে ফেলা হচ্ছে মাজার। কমে যাচ্ছে গানের আসর। এখন তাই জীবিকার জন্য নতুনভাবে ভাবতে হচ্ছে।’
মাজার ভাঙায় জামাল বাউলদের মতো প্রান্তিক অনেক শিল্পীর গানে ব্যস্ততা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে অগুনতি বাউল, বাদকদের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকাতে। জামালও সেই পরিস্থিতির শিকার। বাধ্য হয়ে তাই এখন সংগীত নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। বেরিয়ে আসতে চাইছেন মাজারের জীবন থেকে।
তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এখন মাজারগুলোয় গান করার সময় ভেতরে একটি চাপা আতঙ্ক কাজ করে, ভয় হয় মনে। কারণ, আগের মতো নিরাপদে গান করার পরিবেশ আর নেই। কে কখন কোন দিক দিয়ে হামলা করে—সেই ভয় প্রতিনিয়ত সবার ভেতরে বিরাজমান। এভাবে তো গান-শিল্পচর্চা হয় না। হতে পারে না। এটি বন্ধ হওয়া উচিত, তা না হলে আমার মতো অনেকেই এখান থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবেন। মাজারে মাজারে গান করে আমাদের জীবন-জীবিকা চলে। এখনই যদি মাজারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে কয়েক মাসের মধ্যেই এখানে আর গান হবে না, বন্ধ হয়ে যাবে সাধনাও। সরকারকে তো ভাবতে হবে বিষয়টি নিয়ে।’
তবে তিনি আরও যোগ করেন, ‘কষ্ট লাগে তখন যখন দেখি মাজার রক্ষায় যে বাউলদের এগিয়ে আসার কথা, তারাও ঘাপটি মেরে আছেন। আমাদের নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। এজন্যই আমি এখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। কারণ, হামলাগুলো হওয়ার পর আমাদের যে হাদিয়া ছিল সেটাও আসা বন্ধ হয়ে গেছে।
এখন পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাই যুদ্ধ। যেহেতু গান-বাজনা ছাড়া কিছুই পারি না, এটা করেই বাঁচতে হবে। তাই মাজার থেকে বের হয়ে নতুনভাবে গানের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। যেমন আধুনিক সংগীত নিয়ে কাজ করতে চাই। যদি একটা সুযোগ হয়, তাহলে বেঁচে থাকতে পারব। কারণ রিকশা চালানোর যোগ্যতাও নেই আমার। বাউল গান ছাড়া কিছুই জানা নেই।’
বলতে বলতে অনিশ্চিত জীবনের কথা ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই বাউল। তিনি মনে করেন, তাদের মতো প্রান্তিক বাউলদের থেকে বর্তমানে রিকশা চালকরাও ভালো জীবন কাটাচ্ছেন। অন্তত প্রতিনিয়ত হামলার আতঙ্কে থাকতে হয় না। মৃত্যুর ভয় নেই। পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরার চিন্তা নেই। ‘আমি রিকশাওয়ালা ভাইদের ছোট করে বলছি না কথাগুলো। শ্রমজীবী যে কোনো মানুষই মহান। আমি কেবল উদাহরণটা দিলাম বর্তমানে বাউল শিল্পের করুণ অবস্থাটা বোঝাতে’—যোগ করেন জামাল বাউল।
জামালের সংসারে স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র সন্তানসহ তিনজন সদস্য। বেশ কষ্ট করে সংসার চালাতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
মনে চাপা কষ্ট নিয়ে জামাল বলেন, ‘মাজারে গান গেয়ে যেমন থাকা দরকার, তেমন হয়তো থাকতে পারিনি। তবে কখনো অভাব চেপে বসেনি জীবনে। চাহিদাহীন পরিবারে ভালোই কেটেছে জীবনটা। এখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চিন্তা হয়। আরও যারা এ পেশায় জড়িয়ে আছেন, তাদের জন্য চিন্তা হয়। এ বয়সে এসে জীবন নিয়ে এমন অনিশ্চয়তায় পড়তে হবে, এসব ভাবনা ভাবতে হবে তা কখনো কল্পনাতেও আসেনি।’
তার কাছে জানতে চাওয়া হয় ছেলেকে এ পেশায় যুক্ত করার ইচ্ছা আছে কি না। এরপর অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই জানান, আগে চাইতেন তারই মতো তার ছেলেও যেন এ পেশায় আসে। বাবার কাছ থেকে পাওয়া সংগীতের চর্চাটা তিনি ছেলের মধ্য দিয়ে বংশ পরম্পরায় টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি তাকে ভিন্ন কিছু ভাবতে বাধ্য করছে। তিনি এখন আর চান না তার মতো তার ছেলের জীবনটা অনিশ্চয়তায় কাটুক, হুমকিতে পড়ুক।
মন্তব্য করুন